🎀পাঠশালা🎀

Mohammed Tajul Islam
By -
0

                                       🎀পাঠশালা🎀

                                                      মোহাম্মদ  তাজুল  ইসলাম




 


 হাঁটু পরিমাণ কাদা জলে মৎস্য শিকার করছিল ওরা তিন বন্ধু :-আরমান, সেতু ও কিরন। কাদার গভীরতা বেশি থাকায়, মাছ শিকারে  বেগ পেতে হচ্ছিল ওদের । রাস্তার ধারে ছোট জলাটি ছেঁচে ফেলতে ইতিমধ্যে তিন ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়েছে । থালার এক প্রান্ত কাদার ভিতর বসিয়ে, অন্য  প্রান্তে বাম হাত, তলায় ডান হাতের শক্ত চাপে কাদাগুলি ছিটকে ফেলছিল  ওরা এবং   দৃশ্যমান ট্যাংরা, পুঁটি , টাকি. ও গুচি ,  ইত্যাদি মাছ ,মহা আনন্দে ধরছিল তিন সহপাঠী । ওরা   গয়েরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী । ছোট গ্রামখানি প্রকাণ্ড বিলে ঘেরা, লাউ -কুমড়ার মাচান, বনফুল  ও ফল-ফলাদি গাছপালা বেষ্টিত গ্রামটি ,চৈত্রের ভর দুপুরে  বিলের মাঝ হেঁটে চলা  দূর  পথিককে কাছে ডাকে ,সুশীতল ছায়ায় একদণ্ড গা জুড়ানোর জন্য । বর্ষা মৌসুমে চারিদিক শুধু  পানি আর পানি । নওগাঁ সদর উপজেলা চত্বর থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান  ।   এ সময়   গ্রামে সংযুক্ত  মেঠো পথটির কিয়দংশ  প্রায় পানিতে নিমজ্জিত থাকে । 


মৎস্য শিকারের উদ্দেশ্যে  সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। ক্রমেই বেলা বাড়ছে, কাদায় মাছগুলি নিঃজীব  লেপটে থাকায় চিনতে কষ্ট হচ্ছে । কিরন মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, চিন্তা করিস না, বেলা যত বাড়বে, সূর্যের তাপ তত বেশি পড়বে, কাঁদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মাছগুলো, গরমের  উপরে উঠে আসবে ,নড়াচড়া করবে ,তখন ওদের ধরা সহজ হবে ।


  আরমান বললঃ তোর বুদ্ধি মন্দ নয় ।

সেতু বললঃ এজন্য আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে । পাঠশালায় যাওয়ার সময় পার হয়ে যাবে ।

  আরমান, তুই কি আজ স্কুলে যাবি না ?

    আরমানঃ ক্ষীণ স্বরে বলল যাব ।



কিরনঃ  চেয়ে দেখ, ঐ  দূরে- বিলের মাঝখানে অনেক সাদা বক পড়ে আছে ।  ওখানে আমি  বীতংস পেতে রেখেছি ।   নিশ্চয়ই আজ একটা  শিকার   ভাগ্যে জুটবেই । তাছাড়া  ৮/৯টি ভেড়া মাঠে চড়ছে ,আমি বিদ্যালয়ে যাব না ।

 কিরন ,এ গ্রামে তার এক দুর- সম্পর্কের খালার বাড়ি থাকে ,খালু গ্রামের একজন ধনাধিপ ব্যক্তি। তিনি কিরনের লেখাপড়া ব্যাপারে যথেষ্ট  উৎসাহ দেন এবং সহযোগিতা করেন। কিন্তু সংসারের কাজের বোঁঝা  এতটাই বেশি থাকে যে, সে সকাল-সন্ধ্যা পাঠ অনুশীলনে সময়ই পান না । ফলে শ্রেণি  পাঠে সহপাঠীদের চেয়ে সব সময় পিছিয়ে থাকে । এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ গড়ে উঠেছে তার মাঝে, সে বিদ্যালয়ে যেতে  নিরুৎসাহি বোধ করে । 


স্কুলে যাওয়ার সময় হলে, সেতু বাড়ি যেতে চাইলো । কিরণ বলল ঃ  তুই চলে গেলে আমরা দুজন মাছ ধরে আধাধি ভাগ করে নেব , তোর জন্য রাখবো না ।

সেতু বললঃতাই করিও, আমি চললাম ।

সেতুর প্রস্থানে আরমানের বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগ্রহকে কিছুটা বাড়িয়ে তুলল । কিন্তু অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হবে, সে দ্বৈত্য চিন্তার আবর্তে তালগোল পাকিয়ে বিদ্যালয় না যাওয়ার  সিদ্ধান্তে অটল রইল ।


ওর জননী একজন রাঁড়ি রমনী ।  সংসারে  আরমান, তার অনুজ বোন চৈতি ও মা, তিন  সদস্যে। পিতৃহীন  , অভাবের সংসারে সন্তানদের দুবেলা  দু”মোঠো  ভাত মুখে তুলে দেয়ার দায়িত্ব মা র   কাঁধে। সন্তানদের  অন্ন -বস্ত্র,বিদ্যালয়ে লেখা-পড়ানো খরচ জোগাতে  ,  প্রতিবেশী  ও নিকট জনের বাড়িতে প্রেষণী বৃত্তির করেন, তিনি । ঐ দিন কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে  ঘরে  ফিরে দেখলেন, আরমান বাড়িতে  নেই । ঘরের পাশে   রাস্তা দিয়ে  তার কয়েকজন  সহপাঠী গল্পের তালে পাঠশালায় যাচ্ছিল । ওদের একজন উচ্চকণ্ঠেঃ-আরমান ,আরমান - স্কুলে যাবি না ? কয়েকবার ডাকলো,- মার কানে এসে পৌঁছল । মা ব্যস্ত হয়ে পড়ল,বাহিরে এদিক-ওদিক খুঁজে তার কোন হদিস করতে পারল না , অসহ্য যন্ত্রণা তাকে ক্ষোদিত করল । দুঃখ -কষ্ট ও ক্ষোভে  কাঁদো- কাঁদো  নয়নে  নিজেকে শুধালো, তার এই    ঝিরিগিরি    কার ভালোর জন্য? কিসের মায়ায় সে এ সংসারে বাঁধা ?  কার মুখ পানে চেয়ে তাঁর এ বেঁচে থাকা ? যার আশ্রয় এ মুল্লুকে  ঠাঁই  হয়েছিল- সে মাঝপথে একা ফেলে পালিয়েছে । ভাবতে ভাবতে দু নয়নে  অশ্রু গড়তে লাগলো, বারান্দা একটি খুঁটির পাশে নীরবে বসে রইল।



 দুপুর গড়িয়ে আরমান কর্দমাক্ত শরীরে বাড়ি ফিরল ।  শিকারকৃত মাছ গুলি , খালুই মুখ চেপে  উঁচু করে ,উঠানে প্রবেশ করল ।অতি উৎসাহে মাকে বলল, দেখ মা,  অনেক মাছ ধরেছি,  টেংরা পুটি, গুচি, পুইয়া ,শোল -শাটি, কই, শিং  অনেক !  আমাদের বেশ কদিন চলে যাবে, হাটে মাছ কেনার  চিন্তা করতে হবে না । মা চুপ করে রইল, প্রতিত্তোর  করল না । 


কিছুক্ষণ পর মা বললঃ-  স্কুলে গেলি না কেন ?

 আরমানঃ- মা, আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু —-----------------( কথা শেষ না হতেই)। 

মা বললঃ- কিন্তু কি ? হাতের পাশে একটা শক্ত ডুমুরের ডাল তুলে নিয়ে ,সপাটে পিঠের উপর চালাতে লাগলো । আরমান মার মুখ পানে বিনম্র দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো । আঘাতের পর আঘাত যত গতিতে চলতে লাগলো । আরমানের মাছের খালুই হাত থেকে ছিটকে উঠানের উপর পড়ল । ডুমুরের ডালটি আঘাতের চোটে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল । মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোর আর লেখাপড়া করার দরকার নেই । তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা, এক্ষুনি যা। আমি  আর তোর মুখ দেখতে চাই না । তারপর উঠানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আরমানকে নানানবাক্যে ভৎসনা করতে লাগলো ।   আরমান সেখানে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল, বেশ কিছুক্ষণ পর উঠান থেকে  বেড়িয়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেল । গ্রামের  দক্ষিণ মুখী মেঠো পথ ধরে চলতে লাগলো ,চলতে চলতে পথের ধারে একটি পুকুরপাড়ে  ফলদবাগানের গাছের ছায়ায় এসে বসল ।মাথার মধ্যে হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, কাণ্ডে হেলান দিয়ে আনমনা  দৃষ্টিতে  ভাবছিল,হঠাৎ আমরুত গাছে মগডালে চোখ পড়ল  ,একটি পাখির বাসা , বাসায় কয়েকটি ছানা ,মা পাখিটা অতি যত্নে ঠোঁটের ভিতর ঠোঁঠ  দিয়ে ছানাদের আহার করাচ্ছে , ডানা মেলে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সূর্যের প্রখর তাপ থেকে আড়াল করাচ্ছে । আরমান মনে মনে ভাবলো মার ভালোবাসা কত  গভীর। বিদ্যালয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি তার সঠিক ছিল না । যথা সময়ে বিদ্যালয়ে গেলে ,মা রাগ করত না। শরীরের কাদাগুলো ততক্ষনে শুকে  চট চটা সাদা হয়ে   লেগে গেছে , কতকটা ঝুরঝুর খসে  পড়ছে ।নানা কথায় মনের মধ্যে আনাগোনা করছিল, ,কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল সেটা মনে নেই। 


এটা হাজী সাহেবের  পুকুর সংলগ্ন বাগানটি ও তাঁর । একজন সৎ ও ধার্মিক মানুষ হিসাবে  সমাজে পরিচিত ।  তিনি  পিতৃহীন আরমান কে বরাবরই স্নেহ করতেন  ।দূর থেকে দেখলেন, বাগানে আমরুপ গাছের গোড়ালিতে অর্ধ তন্দ্রায় একজন  বালক শুয়ে  আছে । কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুই?

 এখানে শুয়ে আছিস কেন?

 আড়মোড়া দিয়ে আরমান উঠে বসলো, অবাঙমুখে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে রইল । তিনি বুঝলেন, হয়তো কোন অপরাধের জন্য মা তাকে তিরস্কার করেছে । জিজ্ঞাসা করলেন ঃকি হয়েছে তোর ?

 মা বকেছে ? না তোর দাদু বকেছে ?

 আরমান চুপ করে রইল । তিনি  বললেনঃ আয় ,আমার সঙ্গে আয় । আরমান ইতস্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে  আবার মাথা নিচু করে রইল । হাজী সাহেব পিতৃহীন শিশুটিকে আগে থেকেই ভালবাসতেন, তার প্রতি কিছুটা দুর্বলতা ছিল তাঁর, তিনি স্নেহভরে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলেন, আয় ভাই, আমার সঙ্গে আয় !


বিকেলে  আরমানের দুই বন্ধু পাঠশালা থেকে বাড়ি ফেরার পথে তার মাকে জানালো- আরমান ওপাড়ার, হাজী সাহেবের বাড়িতে আছে । মা শুনলেন,তাদের কাছে এ বিষয়ে অতিরিক্ত কিছু জানতে চাইলেন না । শেষ বেলায় অসাঢ় মনে সংসারের বাঁকি কাজে গুলোর দিকে মনোযোগ দিলেন ।


আরমানদের বাড়ি ও তার পিতামোহের বাড়ি,রাস্তার এপার ওপার, হাত কুড়ি  ব্যবধানে পাশাপাশি ।

 সন্ধ্যায়  দাদু হাট থেকে ফিরে, আরমানদের বাড়ির দরজায় এসেঃ- আরমান, আরমান কোথায় রে দাদুভাই, —---------------------- ।ডাকতে ,ডাকতে বাড়িতে প্রবেশ করল । সামনে তার মাকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল- ছোঁড়াটা কোথায় বৌমা ?হাট থেকে ওর জন্য গুড়ের গজয়া  এনেছি, নাও, ওকে দিও।

তিনি আরো জিজ্ঞাসা করলেন- আজ কি পিরোজপুরি স্কুলে গিয়েছিলে মা ? হেডমাস্টার সাহেব আমাকে কয়েকদিন আগেই বলেছিলেনঃ- আজ কি না, ওদের উপবৃত্তি টাকা দেওয়া হবে । তোমাকে বলতে ভুলে গেছি মা ।


  আরমানের মা বললঃ- হ্যাঁ ,গিয়েছিলাম ।

  আরমানের দাদু জিজ্ঞাসা করলঃ- উপবৃত্তির টাকা কি পেয়েছ, মা ?

 মা বললঃ- হ্যাঁ, পেয়েছি । এক মাসের টাকা কাটা গেছে, তিন মাসের মধ্যে দু মাসের টাকা পেয়েছি। আরমান,  ঐ মাসে বেশ কয়েকদিন বিদ্যালয়ে যায়নি ।

দাদু বললঃ- আর ওমনি ১০০ টাকা কেটে ফেললো । এসব মাস্টারদের চালাকি, মাস্টার বেটারা তেমন সুবিধা লোক নয়।- ওদের বোঝা উচিত, এই টাকা গরীব পিতা-মাতার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালাতে কতই না উপকারে আসে ! হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে দক্ষিণপাড়ায় রাস্তার মোড়ে- এই নিয়ে লোকজন অনেক কথাবার্তা বলছে । অন্য ছেলেমেয়েদের ও টাকা কেটেছে- এর একটা বিহিত করতে হবে, মা । আমি কাল স্কুলে যাব ।কচিকাঁচা ছেলেমেয়েরা বাড়িতে খেলায় মত্ত হয়ে অথবা অসুখ-বিসুখে স্কুলে  না যেতেই পারে  ! তাই বলে এই ছূত ধরে টাকা কাটতে হবে ,এটা  কোন আইনে লিখা আছে ? আমি এর বিহিত করেই ছাড়বো, তর্জন- গর্জন করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । আদরের নাতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি তিনি খানিকটা ভুলে গিয়েছিলেন । 


পরে দিন আরমানের দাদু যথাসময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলেন । পরনে লুঙ্গি ও অংসে  গামছা চেপে শিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই-একজন শিক্ষক সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,আপনি কাকে চান  ? 

 দাদু বললঃ- আমি প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করতে চাই।

তিনি তাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বিদ্যালয়ে আসতে হলে একটা সার্ট বা গেঞ্জি বা পাঞ্জাবি ন্যূনতম কিছু একটা পরিধান করে আসলে ভালো দেখায়, আপনি একেবারে খালি গায়ে এসেছেন । শিক্ষকের এই উপদেশ দাদুর ভালো লাগলো না, তিনি এতে অপমান বোধ করলেন । এমনিতেই শিক্ষকদের সম্পর্কে দাদুর ধারণা ভালো না, তদুপরি উদ্ধৃত উপদেশাবলী মেনে বিদ্যালয়ে আসতে হবে ।  তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বললেন,আমি আপনাদের  নিমন্তন্ন  দিতে আসিনি যে , আমাকে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে আসতে হবে ।এমন অপ্রত্যাশিত উত্তরে শিক্ষক কিছুটা বিব্রত বোধ করল,  কথা না বাড়িয়ে শ্রেণীকক্ষের দিকে চলে গেলেন । ভাবলেন বিদ্যালয়ের কোন কর্মকাণ্ডে তিনি অসন্তুষ্ট ,অভিযোগ বা পরামর্শ কিছু একটা নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে এসেছেন ।





 আরমানের দাদুর উচ্চস্বরের কথাবার্তার  কিয়দংষ  ইতিমধ্যে প্রধান শিক্ষকের কানে পৌঁছে ছিল ।তিনি ভেতরে প্রবেশ করতেই ,সালাম দিয়ে  তাঁকে একটা কেদারায় আসন গ্রহণ করতে বললেন । 

দাদু বললেনঃ- আমি বসতে আসিনি, আপনার কাছে জানতে এসেছি । আপনি আমার নাতির উপবৃত্তির টাকা কর্তন করেছেন কেন ? 

প্রধান শিক্ষক বললেনঃ- আপনি বসুন; আমি আপনার সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেবার চেষ্টা করছি । আপনি দয়া করে  আগে বসুন । প্রধান শিক্ষকের অনুরোধ তাঁর কর্ণগোচর হলো না । তিনি বলেই চললেন, সরকার গরিব পিতা-মাতার সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবার জন্য সহায়তা স্বরূপ উপবৃত্তির টাকা দেন । আপনি তা কর্তন করার কে ? সরকার  তো আপনাকে বেতন -ভাতা দেন ,সেগুলি খেয়েও কি আপনার পেট ভরে না ? তারপরও আপনারা কলমের খোঁচায় উপবৃত্তির টাকা   কেটে ভাগবাটোয়ারা করে নেন ।- এটা কি আমি বুঝি না ! আমার নাতির উপবৃত্তির টাকা কেটেছেন আপনি  । আপনি তা ফেরত দিবেন - এটাই আমার শেষ কথা । আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাই না ।

প্রধান শিক্ষক সাহেব তার অযৌক্তিক ও অপমানজনক বাক্য শ্রবণান্তে অন্তরে কষ্ট নিলেন না বা মর্মাহত হলেন ।পল্লী গ্রামে শিক্ষকতা করতে হলে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়, অপমান বা কষ্ট  সব কিছু ভুলে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়। তিনি আরো একবার চেষ্টা করলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের  জন্য। তিনি বললেন, আপনার যা খুশি তাই বলুন, যা মন চায় তাই বলুন, যদি আমাকে গালি দিও সুখ অর্জন করতে পারেন তবে তাই করুন । দয়া করে আপনার বক্তব্য শেষে, আমার দুটো কথা বলার সুযোগ দিবেন, অনুরোধ রইলো । 

দাদু বললেনঃ- আমি যা বলেছি, তা আপনি বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। আমার আরো কিছু বলার ছিল। কিন্তু আমি তা বলতে চাই না। আপনি আগামীকালই আমার নাতির উপবৃত্তির টাকা ফেরত দিবেন ,বলেই দাদু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন । 

প্রধান শিক্ষক সাহেব এবার নিরুপায় বললেন,  শিক্ষকরা কি উপবৃত্তির টাকা দেয় ?উপবৃত্তির টাকা দেয় ব্যাংক কর্মকর্তাগণ, শিক্ষকদের উপবৃত্তির টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ কোথায় ? প্রধান শিক্ষক সাহেবের কথাগুলি সমাপ্ত হবার পূর্বেই, তিনি কক্ষ ত্যাগ করলেন । 


তিন দিন পার হলো,  আরমান এখনোও বাড়ি  ফিরেনি  । দিন যত যাচ্ছে- মার অন্তরে সন্তানকে দেখা ব্যাকুলতা ততোই বাড়ছে । যার পদচারণে সারাক্ষণ  গোটা বাড়ী আনন্দ মুখরিত থাকতো-তার অনুপস্থিতে, সবকিছুই যেন মলিন, নিথর -নিরব হয়ে গেছে, কথা বলছে না, টেবিলের উপরে ছড়ানো ছিটানো  বইগুলি, খেলার বল, লাটিম  স্পর্শ করে মা ছেলেকে  খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। সুপ্ত বেদনা অন্তর ও দেহকে পুড়ে ছারখার করছে। মা কয়েকজন লোক মারফত ও পাড়ায় খবর পাঠিয়েছিল- আরমানকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য কিন্তু তাতে ফল হয়নি । একবার ভেবেছিলেন নিজেই ওপাড়ায় গিয়ে আরমানকে নিয়ে আসবেন। গতকাল ওর দাদুকে বলেছিলেন, তিনি কি করলেন? তাও জানা হয়নি । সব চিন্তা গুলি মাথার মধ্যে ঘুরপাক  খেয়ে মতিচ্ছন্ন হবার উপক্রম হচিছল ।তিনি বারান্দায়  মাদুর পেতে নিথর দেহে পড়ে রইলেন ।  দুপুর গড়িয়ে চলল, রুটি বানানোর প্রস্তুতিতে, আবার উঠে বসলেন  । ছোট উনুন পাড়ে, গমের ময়দার খামির তৈরি করতে গেলেন ।

এমন সময় চৈতি চিৎকার দিতে দিতে বাড়িতে প্রবেশ করল, বলল:- মা ,মা, আরমান ভাই ,বাড়িতে আসছে ! 

আরমান বাড়িতে প্রবেশ করল । মা তাড়াতাড়ি উনন থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়ালো । দাদু  আরবানের হাত ধরে উঠানে প্রবেশ করল । সন্তানের  চোখাচোখি হতে নিজের  অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না । আরমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল ,মাকে কষ্ট দিয়ে দূরে থাকতে খুব ভালো লাগে তোর !

 শ্বশুর বললঃ- আমি সব শুনেছি ,ছোড়াটার সামান্য অপরাধে অমন সাজা দেওয়া তোমার ঠিক হয়নি ,বউমা । যার ,সারা বছরে  দশটি আবদারের দুইটি পূরণ করতে পারিনা আমরা, - তার প্রতি অতটা কঠোর হওয়া সাজেনা । কামালের হাত ছেড়ে দিয়ে  বাহিরে যেতে যেতে মনের আক্ষেঁপে   বলতে লাগলো , আর কি ! কাকে বা কি বলি ! কে বা আমার কথা শুনবে ! বুড়ো হয়েছি, অর্থের জোর কম ! কাউকে কিছু দিতে পারিনা, তাই সংসারে  এ বুড়োর আদেশ -উপদেশ মূল্যহীন ! মূল্যহীন মানুষের কথা এ সংসারে সবার কাছে বোঝা । বলতে বলতে তিনি বাড়ির সীমানা ত্যাগ করলেন ।

 মা, আরমানকে উননের পাশে বসালেন ।  সে একটি পিরিতে আসন গ্রহণ করল । মা  উনুনের জ্বাল ধরিয়ে, রুটি শেকতে লাগলেন । ললাটের উপরে  তখনোও ডুমুরের আঘাতটি স্পষ্ট ছিল । সন্তানের মুখের পানে চেয়ে -সেটা লক্ষ্য করে,- নিরবে  আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন । 

একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, অনেক কথা বলার আছে কিন্তু তা হয়ে উঠছে না, আরমান  মাথা নুয়ে রুটির উপরের  ছোট ছোট ফোরণ গুলিতে চিমটি কাটছিল, মাঝে মাঝে দু /একটি মুখে পুড়ছিল। মা তা খেয়াল করছিল । আর একটি গরম রুটি থালায় রেখে  মা  বললেন  ,নে খা বাবা,তাড়াতাড়ি খা ঠান্ডা হয়ে যাবে !

আরো কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর, আরমান শান্ত  ও গম্ভীর কণ্ঠে বললো:- মা ,কাজ করে অনেক টাকা পাওয়া যায়। কাল থেকে আমি কাজ করবো মা । অনেক টাকার রোজার  করববো, আমাদের আর দুঃখ থাকবে না। তোমাকেও আর পরের দ্বারে  ঝিগিরি  করতে হবে না । 

 হঠাৎ সন্তানের মুখে  কথাগুলি শুনে, কিছুটা অবাক হয়ে গেলে, তার মুখের দিকে চেয়ে রইল । মা বলল, তুই কি বলতে চাচ্ছিস, আমি তোর কথা বুঝতে  পারছিনা । আরমান বলল,  তোমায় আমি আর কখনো পরের বাড়িতে কাজ করতে দিব না। এটা আমার শেষ কথা ।

 আমি আর লেখাপড়া করবো না, স্কুলে যাব না।

মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তার এই ধারণা গুলি প্রকৃষ্ট যুক্তির মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করার সাধ্য তার নেই । ছেলের ঋণাত্মক  দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য উপযুক্ত মানুষের সাহায্য প্রয়োজন ।তিনি আর কথা বাড়ালেন না ।

 পরে দিন মা ও ছেলে সকাল সকাল বিদ্যালয়ে উপস্থিত হলেন । শিশুরা শ্রেণীকক্ষ খোলার অপেক্ষায় বারান্দায় বই হাতে দাঁড়িয়ে ছিল ।  প্রধান শিক্ষক সাহেবের আগমনে সবাই হই হই করে ,স্যার আসছে , স্যার আসছে , কলরবে মেতে উঠলো ।প্রধান শিক্ষক সাহেব দেখলেন, আরমান মাকে নিয়ে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে । তিনি বললেন:- গত কয়েকদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত কেন ,আরমান? অসুখ-বিসুখ হয়েছিল নাকি ? নিজ কক্ষে প্রবেশ করতে করতে তিনি তাদের ভেতরে আসতে বললেন । টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে- সামনের আসনে তাদের কে বসতে বললেন ।মা সবিস্তারে  আরমানের মনবাঞ্জা ,প্রধান শিক্ষকের নিকট পেশ করলেন এবং অনুরোধ করলেন যথার্থ উত্তর দানের মাধ্যমে কামালের ভুল ধারণা গুলি  দূর করতে ।


প্রধান শিক্ষক সাহেব আরমানের দিকে চেয়ে হেসে বললেন, আজ স্কুল শেষে, তোমার খোঁজ খবর নিতে তোমাদের বাড়িতে যেতাম। তুমি মাকে সঙ্গে নিয়ে আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আরমান, তুমি একদিন বলেছিলে, তুমি নাকি একটি ফুলের বাগান করেছো? সেখানে নানান ফুল গাছের চারা লাগিয়েছ ? চারা গুলি কেমন আছে ?

 আরমান:- ভালো আছে ,স্যার!  খুব ভালো আছে !দিন দিন সেগুলি বড়ও হচ্ছে ।

 প্রধান শিক্ষকঃ- সেগুলির পরিচর্যা কে করে ?

  আরমান :-   স্যার, আমি । মাও করেন ।

প্রধান শিক্ষক :- সেগুলিতে কি ফুল ফুটেছে ?

 আরমান :  না, এখনো  কলি আসেনি ।

 প্রধান শিক্ষক:- একদিন কলি আসবে, ফুল ফুটবে, চারিদিক সুবাসিত করবে ।

 আরমান:- সেদিন আমার খুব ভালো লাগবে, মন আনন্দে ভরে যাবে । আমি সেদিনের অপেক্ষায় প্রতিদিন চারাগুলির যত্ন করি, পানি দিই, আগাছা পরিষ্কার করি,না,  ওদের যত্নের কোন ত্রুটি রাখি না ।

 প্রধান শিক্ষক:- একজন শিশু- সে  একটি ছোট চারা গাছ । মা তার পরিচর্যা করেন । সে পৃথিবীর আলো বাতাসে আস্তে আস্তে বড় হয় । মা যথা সময়ে আহার দেন , অসুখ বিসুখের শুশ্রূষা করেন, শিক্ষা অর্জনের সুযোগ করে দেন,নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠান ।  একদিন সে মানুষের মতো মানুষ হয়ে, ফুলের মত চারিদিকে সুবাস  ছড়ান । তখন খুশিতে মা বাবার মন প্রাণ ভরে যায় ।

 একজন মালী যেমন, তার বাগানের ফুলের  সৌন্দর্য ও সুবাসে উঠ্বেলিত হয় । পরিশ্রমের কথা ভুলে যায় । একজন মাও- তাঁর সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করতে পারলে, অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যান । সন্তানের সাফল্যের, নিজের জীবনকে সার্থক মনে করে, -এটাই জগদ্বিধান । এটাই সচেতন অভিভাবকদের  কামনা ।

তুমি কি চাও তোমার মা কষ্ট পাক ? তুমি কি চাও সারা জীবন তোমার মা পরের বাড়িতে  দাসী- বান্দির   কাজ করুক ?

  আরমান:-  না  স্যার  চাই না, কখনো চাই না ।

 প্রধান শিক্ষক :- তোমার মা অনেক কষ্ট করে তোমাকে লেখাপড়া শিখাচ্ছে ? তোমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য । একদিন তুমি মানুষের মত মানুষ হবে, সমাজের প্রতিষ্ঠিত হবে, সবাই তোমাকে সম্মান করবে, সংসারের অভাব অনটন দূর হবে। সেটা দেখে তোমার মার বুক আনন্দে বুক ভরে যাবে । তার সারা জীবনের কষ্ট সার্থক হবে ।

 সেটা কি তুমি চাও না ?

 আরমান:- চাই  স্যার , নিশ্চয়ই চাই ।

  প্রধান শিক্ষক :-  তোমার মা তোমার কাছে কি চান ?

আরমান :- আমি যেন লেখাপড়া  করি, নিয়মিত পাঠশালায় যায়, লেখাপড়া শিখে  মানুষের মত মানুষ হই!

প্রধান শিক্ষক সাহেব :-আমার মনে হয় তুমি সঠিকটি বলছ না । তোমার মা কষ্ট পাক, সারা জীবন পরের দ্বরে ঝিগিরি করুক,- সেটাই তুমি চাও !

 আরমান:- না স্যার, চাই না, কখনো চাই না ।

প্রধান শিক্ষক ;- তাহলে তুমি এখন থেকে মার কথা শুনবে ? নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসবে ?

 আরমান :- নিশ্চয়ই আসব, মার কথা কখনো  অবাধ্য হবেনা, তার সব  আবেশ মেনে চলবো ।

সন্তানের কথা শুনে মারব খুশিতে ভরে গেল ,আনন্দে  দুচোখ মুছতে মুছতে আরমানকে বিদ্যালয় রেখে বাড়ির পথে রওনা হলো ।



Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)