স্মৃতিচারণ
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
[ ১ম সর্গ ]
অনেক কথা মনে পড়ে আজ
দিন যায় বেলা শেষে,
বিদায়ী সূর্য অন্তিম লগ্নে
ফিরে চায় মলিন হেসে II
শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনা বা ডাঙ্গুলি খেলার আনন্দঘন দিনগুলো ফিরে পাওয়ার আকুতি কার মনেই না জাগে !
ফিরে যেতে চায়, খুঁজে পেতে চায়,অমূল্য হারানো স্মৃতির পাতায় পাতায় ! তার স্বাদ যেন হেমন্তের স্নিগ্ধ শীতল, শিশির ভেজা সকালের মতো !
আবার জীবন যুদ্ধে দারিদ্রতার চরম কষাঘাতে, এক মুঠো ভাত খেয়ে বা না খেয়ে, পায়ে হেঁটে শহরের তিন ক্রোশ দূরের বিদ্যাপীঠে জ্ঞানার্জন করে , অতঃপর মহামূল্যবান বস্তুটিকে গ্রীষ্মের তীব্র তাপ দাহে অথবা বর্ষার কর্দমাক্ত মেঠো পথে বয়ে ঘরে ফেরা, ”সেটা কি চাট্টিখানি কথা” ।
আর ঈশ্বরের অশেষ কৃপায়, সে ব্যক্তিটি যদি উন্নত জীবনের সন্ধান পায় অর্থাৎ নিজেকে সু প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তার কাছে ফিরে দেখা -’শৈশবকাল’,-নয়নের দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়া কষ্টেরস্মৃতি বৈই অন্য কিছু নয় ! ভুলে থাকাই শ্রেয় ।
সুকুমার দিনগুলির একদিন । হেমন্তের শেষভাগের সন্ধ্যা । মাঠে আমন ধান কাটা প্রায় শেষ, বিলের মাঝে দেড় বিঘার অধিক উঁচু জমিতে ,প্রকান্ড বাঁশবাগান সংলগ্ন ভাগাঢ় , যেখানে গৃহস্থের মৃত গবাদি- পশু ফেলে দেয়া হয় । চিল -শকুন আর কুকুর - শৃগালের আস্তানা , দিবা-রাত্রি পালাক্রমে বিচারণ ও ভুরি-ভোজের মেলা ।
হে পাঠক, এ দু’চোখে যাহা দেখেছি, তাহাই আপনাদের সামনে বর্ণনা করছি । মনোহর- হৃদয়গ্রাহী বর্ণনার ক্ষমতা বা মেধা আমার মধ্যে নেই ,তবে সত্য বই মিথ্যা লিখব না সেকথা বলিতে পারি ।
তার হাত কুড়ি/পঁচিশেক দূরে, উত্তর-পশ্চিম কোণে, ঘন চারাবন বা কাশবন । বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যায় আবার শরৎকালে কাঁশফুলে ভরে ওঠে । খোলা মাঠের পাখ- পাখালির রাত্রি যাপনের জন্য এই ঘনবনটিই বেছে নিয়েছে তাদের আবাসস্থল হিসেবে।
বছরের অন্য সময়, চৈত্র মাসে , কাশবন কেটে জমির উপর ফেলে রাখা হয় , শুকানোর জন্য । পল্লীর ধনী গৃহস্থেরা ঘরের ছাউনি কাজে বিচালি হিসাবে এগুলো ব্যবহার করে। এদের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ধানের খড়ের চালা, এক বছরেই বর্ষার পানিতে পচে বিনষ্ট হয়ে যায় কিন্তু চারাবনের বিচালি নির্মিত চালা দু/ তিন বছরেও পচে না। তাই গ্রামের জোতদাররা দুই /এক বিঘা জমি ফসল চাষ না করে ,বিন্নার চারা বা কাঁশবন বেড়ে ওঠার জন্য পতিত হিসেবে ফেলে রাখে ।
আমার পড়শি বাল্যবন্ধু , সহপাঠীও বটে, বললঃ আজ সন্ধ্যার ঘড়ি -খানিক ( কিছুক্ষণ) পর তুই আমার সঙ্গে যাবি ?
আমি বললামঃ কোথায়?
সে বললঃ গেলেই বুঝতে পারবি ।
আমি বললামঃ আগে একটু বল না , কোথায় যেতে হবে?
ও বললঃ শোন, তোর জাল আছে ?
বললামঃ ক্ষেপলা জাল ?
ও বললঃ হু ।
বললামঃ আছে ।
ও বললঃ বাস্, তাহলে চলবে । শোন , আমি ক”দিন থেকে ভেড়ার পাল বিল চড়ে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে লক্ষ্য করছিলাম, বিলে ঢেলার মধ্যে লুকে থাকা ঘুটরা-বাউই( বাবুই) পাখিগুলি গোধূলিলগ্নে উড়ে উড়ে এসে কাঁশবনে পড়ছে । ওদের ধরবো চল ।
বললামঃ কেমন করে?
ও বললঃ তুই জালের ক্ষেও দিবি চারাবনের উপর, ওরা শব্দ শুনে ভয়ে উপর দিকে উড়ে উড়ে পালাবার চেষ্টা করবে আর জালে আটকা পড়বে ! তখন ওদের ধরবো ।
আমি বললামঃ বুদ্ধিটা মন্দ নয়, চল !
কথা মত গন্তব্য স্থানে পৌঁছলাম । দু”জনে বুদ্ধি লাগিয়ে অনেকগুলো পাখি ধরলাম । সত্যিই, জাল ক্ষেও দেওয়ার পর,শব্দ শুনে ভয়ে পাখিগুলি উপর দিকে উড়ে পালাবার চেষ্টা করছিল তখন জালে আটকা পড়ছিল। একটা বড় খাঁচার মধ্যে অন্ধকারে পুড়ে রাখলাম ।
পরদিন সকালে বের করে দেখলাম ওগুলো ঘুট-বাবুই( বাবুই) নয়, ও গুলি শালিক, সারস ,দোয়েল ,বুলবুলি, টুনটুনি ইত্যাদি ।
মনের দুঃখে ওদের বাঁধন মুক্ত করে দিলাম। দেখার জন্য পাড়ার অনেক ছেলে -বুড়োর ভিড় জমিয়েছিল, কেউ কেউ মোদের সাহসিকতার প্রশংসা করল আবার কয়েকজন ভৎসনাও করলো । আদুরে, বাড়ির সামনে, তেমাথায় ভীষণ, সাশা- গর্জা ,তর্জন -গর্জন তথা প্রকাণ্ড হট্টগোল বেঁধেছিল । লোকজন আগ্রহভরে তাড়াহুড়ো করে সেদিকে চলল। আমরাও এগিয়ে গেলাম। মানুষের ভিড় ঠেঁলে সামনে এগোলাম, দেখলাম, দুজন ৭৫ / ৮০ উর্ধ্ব বয়স্ক প্রবীণ ব্যক্তি । একজন জোতদার, জনাব এলাহী বক্স মন্ডল (খলিফা মন্ডল ), অপরজন খর্বাকৃতি , গৌর বর্ণের বয়স্ক তস্কর । বয়সের ভারে শরীরের চামড়া নানা অংশে ভাঁজ পড়েছে । সম্ভবত রাস্তায় উপর পড়ে থাকা বাঁশটিই বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে শহরমুখী যাত্রা করেছিল । পাকা বাঁশি তখনোও রাস্তায় উপর পড়েছিল । বৃদ্ধ চোরের উপর কিল- ঘুষি ,চড়- ,থাপ্পড়, সমানে চলছিল । লোকটি মাটিতে মাথা নুয়ে বারবার বলার চেষ্টা করছিল , এমন ভুল আর কখনো হবে না ! ভুল হয়ে গেছে , বাবা ! এবারের মত আমাকে মাফ করে দেন, মন্ডল সাব ! মন্ডল সাহেব চেঁচিয়ে বলছিল, অনেক চেষ্টার পর চোর আজ হাতেনাতে ধরেছি, গত এক বছরের চেষ্টা আজ আমার সার্থক হয়েছে । বিলের মাঝে ডারার উপর বাঁশঝাড়টি আমার, রাতের আঁধারে বাঁশ কেটে সাবাড় করে ফেলেছে, এই চোরাচুন্নিরা । এদের অত্যাচারের গ্রামে বাস করা মুশকিল ।
চোরকে ঘিরে উৎসক জনতার , কেহই আঘাত বা মারপিটের চেষ্টা করছিল না । কেবল সবাই বারবার বলছিল, এই বৃদ্ধ মানুষটি কেমন করে বিলের মধ্যে রাতের অন্ধকারে বাঁশ কেটে নিজ বাড়ি নিয়ে, তার কঞ্চি- কানা পরিষ্কার করে ,কাধে নিয়ে, দেড় ক্রস দূরের শহরে বিক্রির উদ্দেশ্যে যাচিছল ? ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মন্ডল সাহেবের প্রতি চক্ষুর , যে ডাটি সুতা দ্বারা কান পর্যন্ত আটকানো ছিল ,তা ছুটে গিয়ে মাটির উপর পড়ল । তিনি তা খোঁজা-খুঁজিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন । বেচারা, চোর বাবাজি কিছুটা রক্ষা পেল ।
হঠাৎ কি চিন্তায় খানিকটা সাহস মনের মধ্যে জোর বাড়ালো, বললামঃ বড় বাবা, এটা যে আপনার থোঁঁপের (বাঁশ বাগানের) বাঁশ তার প্রমাণ কি ? তার নিজের অথবা অন্য মানুষের থোঁপেরও তো হতে পারে ?
খলিফা মন্ডল সাহেব ততক্ষণ কুপিত দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য ছিলেন । প্রশ্ন শোনে , জিজ্ঞাসা করে বসলেন, কে এই প্রশ্ন করল?
আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে বললামঃ বড়বাবা আমি ।
তিনি খানিকটা শান্ত গলায় বললেনঃ এ প্রশ্ন সবার মনেই জাগতে পারে ।
তিনি বললেনঃ আচ্ছা,তবে বলি শোনো, ফিঙ্গে বা ফিচকা কি কখনো দেখেছো ? বলতো এদের গায়ের রং কি?
বললামঃ কালো।
তিনি বললেনঃ এ পাখির বিষ্ঠা বা মলের রং কি ?
একজন বলল ঃ সাদা।
অন্যরা বললঃ সব সময় সাদা এদের মলের রং।
তিনি বললেনঃ বিলের মধ্যে আমার বাঁশবাগানে উপরে এদের আসা-যাওয়া এতটাই বেশি যে , মগডালে বসে , এদের বিষ্ঠায় নিচের বাঁশের সবুজ পাতা ও কাণ্ড গুলি সাদা হয়ে গেছে।
এরা মাঠে কীট -পতঙ্গ ধরে খায় , মাঠে বিচরণকৃত গবাদি পশুর পিঠে বসে খাবার অনুসন্ধানে সারা পাথার চুষে বেড়াই ।
আবার ভূমি কর্ষণের সময়, চাষির পিছনে পিছনে লাঙলের ভোর বরাবর পোকামাকড় খোঁজে এবং সুযোগ বুঝে অন্য পাখির ঠোঁট থেকে পোকামাকড় কেঁড়ে নিয়েও খায়। এবার মনে হয় এই পাখিটি চিনতে তোমাদের আর কোন অসুবিধা রইলো না।
মন্ডল সাহেব শুধালেন, দেখুন তো তোমরা সবাই, এই বাঁশটির কানার উপর কোন রং দেখতে পাচ্ছেন কিনা ? একটু ভালো করে দেখুন, পর্যবেক্ষণ করে বলুন?
পর্যবেক্ষণ শেষে উপস্থিত জনতার কয়েকজন বললঃ সাদা দাগ দৃশ্যমান, মনে হচ্ছে চুনের দাগ।
মন্ডল সাহেব বললেন হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এটা আমার নিজ হাতের আঙ্গুলে দেওয়া চুনের দাগ । যেন চোর ব্যাটা ফিঙ্গের বিষ্ঠা আর এই চুনের দাগের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারে। আমি প্রায় প্রতিটি বাঁশেই নিজআঙ্গুল দ্বারা চুনের দাগ এঁকেছি রেখেছি ।
উৎসক জনতা সবাই মন্ডল সাহেবের কথাগুলি সরজমিনে মিলিয়ে দেখলো এবং অবাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন। মন্ডল সাহেবের , চোর ধরার চমৎকার কৌশল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দর্শনে উপস্থিত সবার মুগ্ধ হলেন ।
মন্ডল সাহেব আক্ষেপ করে বললেনঃ আমার নিজের ক্ষেত-ফসল, গরু -ছাগলের অত্যাচার থেকে রক্ষা জন্য কাঁচা বাঁশ চিঁরে বেড়া দিচ্ছে । বছর অন্তর দু'চারটা বাঁশ বিক্রি করার সৌভাগ্য আমার হয় না। বছরের পর বছর , এই চোর ডাকাতদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি !
মনবেদনা তথা মনকষ্ট , কখনো চিৎকার করে, কখনো ক্ষীণ কন্ঠে, বারংবার আবৃত্তি করতে করতে,বৃদ্ধ খলিফা মন্ডল সাহেব, বাড়ির পথে রওনা হলেন।
আমরাও ধীরে ধীরে বাড়ির পথে চললাম।
বয়বৃদ্ধ চোর বেচারা অসহায়ত্ব এবং মুক্তি পাবার আকুল কাকুতি -মিনতি, চোখের সামনে ভেসে উঠছিল !
ক্ষুধা কি ?
তার যন্ত্রণা বা কত কঠিন? কত তীব্র ?
যা নিবারণে গ্রামের অশিক্ষিত, দরিদ্র মানুষগুলোই শুধু নয়, শহরের উচ্চশিক্ষিত ,ধনাঢ্য ,সমাজের - কর্ণধার ব্যক্তিবর্গও ন্যায়-অন্যায় বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে , এদেশে ।
খলিফা মন্ডর সাহেব এ গ্রামের একজন সৎ ও ধার্মিক মানুষ । সমাজে সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত । তিনি কখনো কারো সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন কিনা, এটা কারো জানা নেই । বংশ পরমপরায় ধনী হওয়ার কারণে তিনি ছিলেন নিরহংকারী এবং সমাজে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
নিজের অজান্তে শৈশবের পথচলায় কত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, তার সংখ্যায় হিসাব মিলানো মুশকিলঃ-
তার একজন ছিল জহির চৌধুরী,আমাদের গ্রামে বাড়ি।সে সময় জহির চৌধুরী নামে এক ভূমিহীন মানুষ গ্রামে বাস করত। চৌধুরী উপাধির সাথে ভূমিহীন কথাটি বেমানান। তবে এটাই সত্য, উপাধি ধুয়ে পানি খেলে তো আর পেট ভরে না। পূর্বপুরুষদের আমলে হয়তো অঘাত সম্পত্তির অধিকারী ছিল, তাই চৌধুরী উপাধি পেয়েছিল বা ক্রয় করেছিল। তবে বর্তমানে, পূর্বের অবস্থার সাথে আকাশ পাতাল পার্থক্য । ২/৩ শতকের উপর বসত ভিটা ছাড়া কিছুই নাই। সংসারে বারংবার কন্যা সন্তান জন্ম দেন জহির চৌধুরীর স্ত্রী। এবারও ব্যতিক্রম নয়, আতুড়ে ঘর থেকে ধাত্রী বেরিয়ে এসে উঠানে দাঁড়িয়ে জহির চৌধুরীকে বলল, মিয়া ভাই খুশির সংবাদ! মিষ্টি খাওয়ান ! জহির মিয়া পরনের কুঁচকানো পাঞ্জাবির পকেট থেকে দশ টাকার একখান লাল নোট বের করে দিল। খুশিতে ধাত্রী বলল,তুমি এবারও একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হলিন (হলেন)!
দাও আজান দাও!
জহির মিয়ার আশা ছিল ,এবার তার ভাঙ্গা ঘর আলোকিত করে ফুটফুটে পুত্র সন্তান আসবে। ধাত্রীর হাসি-খুশি মুখ খানি দেখে তাই মনে হয়েছিল কিন্তু অনুমানের সাথে মিললো না। খুশি বা দুঃখ কোন কিছুই তাঁর অবয়বে ফুটে উঠলো না। কূপ থেকে এক বালতি পানি তুলে অজু সেরে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আজান দিল। আজান শেষে বিড়বিড় করে বলল, হে দয়াময় , তুমি আমায় যা দিয়েছো, তাতেই খুশি!
অবশ্য জহির চৌধুরীর মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছিল চারটি কন্যা সন্তানের পর পুত্র সন্তান লাভের মাধ্যমে।
গ্রামে বাস করলে কমবেশি জমি -জমা না থাকলে চলে না । শাকসবজি ,আলু -পটল কাজের ফাঁকে অবসরে চাষ করলে সংসারের চাহিদা মিটিয়ে দু -চার পয়সা হাটে বিক্রি করা যায়। জহির মিয়া এক চিমটি আবাদি জমিও নাই, যে তাতে কিছু সবজি চাষ করে সংসারের চাহিদা মেটাবে বা অভাব ঘুচবে। পরের দ্বারে গতর খেটে ৭ সদস্যের পরিবারে আহার জোটানো সহজ কথা নয়।
সেবার বড় বন্যা হয়েছিল, আউশের ধান , পাট অন্যান্য ফসল বন্যায় নষ্ট হয়েছিল । চারিদিক অভাব, গ্রামের বড় বড় গৃহস্থেরও অভাবে, হিসাব করে চলে,কামলা খাটায় । গৃহস্থ বাড়ি কাজের জন্য তেমন ডাক আসে না। খুব প্রয়োজনে তাগদ ওয়ালা, শক্তি বল বেশি কামলাদের ডাকে, যেন কাজ বেশি করতে পারে। তারপরও পরিবারের কর্ণধার বলে কথা, স্ত্রী জরিনা বেগম গতকাল ওপারায় মন্ডল বাড়ি কাজ করে আধা কেজি কাউন দানা পেয়েছিল। সাথে দুমুঠো খুদ মিশিয়ে উননে ঘুমনি(খিচুড়ি) চড়িয়েছে । ছেলে-পুলেদের ক্ষুধা বেশি, যাই হোক চারটা পাতে বেড়ে দিলেই ওরা খুশি ! তখন আর, খেতে দাও !খেতে দাও ! বলে জ্বালাতন করবে না । মার সাথে সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করবে না।
তবু একটা কাজ পাবার আশায় জহির চৌধুরী কাঁধে গামছা ফেলে পিঠে দুহাত বেঁধে ধীরে ধীরে খলিফা মন্ডলের বৈঠকখানা সামনে হাজির হলো, মন্ডল সাহেব বেঞ্চে বসে , সামনে মাথায় হেলে টেবিলের উপরে পত্রিকার পাতায় মনোযোগী ছিল। জহির মিয়া কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা বোধ করি বুঝতে পারেন নাই, মাথা তুলে ঘাড় ঘুরাতেই চোখে পড়ল, জিজ্ঞাসা করলে জহির মিয়া যে, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো একবার গলা খ্যোকর, সারা শব্দ করবে তো!
তা বল, কি উদ্দেশ্যে এসেছো?
জহির মিয়া:-মন্ডল সাহেব কাজ কাম নাই, সংসার তো চলে না।
একটা কাজ দিলে ভালো হতো।
খলিফা মন্ডল:-অভাব ! জহির মিয়া অভাব!
কাজ নাই, কাজ দিতে পারবো না-জহির মিয়া। উপরে উঠে আসো পাশে টুলের উপরে বসো।
জহির মিয়া:-থাক মন্ডল সাহেব, এখানে ভালো আছি,ওখানে আমায় মানায় না ।বরং কাঁঠাল গাছের গোড়ায় মোটা শিকরটার উপরে বসি।
খলিফা মন্ডল:-তুমি বয়সে বড়, ওখানে বসা সাজেনা, পাশে টুলের ওপর বসো।
জহির মিয়া:-গরিবের আবার উপর নিচ, এক জায়গায় বসলে হলো, ছোটলোকের জন্য এটাই উত্তম স্থান।
এখন কি করবো, তার একটা পরামর্শ দেন! দেয়ালে পিঠ যে ঠেকে গেছে।
খলিফা মন্ডল:-জানোতো এবছর বন্যায় ফসল খেয়ে গেছে, চারিদিকে অভাব, নিজের পরিবারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। গৃহস্তরা সুস্থ সবল কর্মঠ কামলা দেখে দু /এক দিন কাজে নিচ্ছে। দুর্বল ,বয়স্ক মানুষদের নিচ্ছে না।, তোমার মত গা গতরে শক্তি কম, বয়স্ক মানুষদের সমাজে কদর কম। তাই বলি কি পরের বাড়ির কামলা দেওয়ার কথা বা চিন্তা ,মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। গাভী লালন পালন করো, সেটা বকনা গরু হলে ভালো হয় । পাথারে সারাদিন ঘাস খাওয়াবে ,দুপুর সন্ধ্যায় দুমুঠো গুড়া- ভূষি মিশে পানি খাওয়াবে। এভাবে দুটো গাভী দেখা শোনা করলে, দুধ বেঁচে তোমার সংসার চলবে।
মন্ডল সাহেবের কথাটি জহির মিয়ার মনে ধরলো। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে নরম সুরে বলল, আমিও তাই ভাবছি। শুধু পরিবারের মতামত জেনে নিতে হবে। বলে জহির মিয়া উঠে দাঁড়ালো, মন্ডল সাহেব তাহলে আসি বলে প্রস্থান করল।
খলিফা মন্ডল:-জহির মিয়া থামো ! বাড়িতে আমার হালের জোড়া বলদ এর সাথে, ভালো জাতের দুধেল গাভী ও লালন পালন করি, তার একটা বোকনা বাছুর আছে।
মন চাইলে আদি (আধাধি ) হিসাবে তুমি নিতে পারো। আমি তোমার কোন উপকারে আসতে পারলে ভালোই লাগবে। পরিবারের সাথে আলোচনা করে তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও।
কি শুভক্ষণে কথাটা মন্ডল সাহেব বললেন! তা সত্যিই ফলে গেল। আজ জহির মিয়ার গোয়াল ঘরে দুটো গাভী । আদর যত্নে লালন পালন করে দুটো মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি আছে আরো দুটো মেয়ে ও একটি নাবালক ছেলে। পিছের মেয়ে দুটি চৌকস , মেধাবী ও সুন্দরী। বিয়ের ঘর এদিক-ওদিক থেকে আসতেই থাকে। ওরা বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও পাড়ার কেতাবী মহিলার শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে কোরআন শিক্ষায় পারদর্শী , তার সুনাম পাড়ার সবার মুখে মুখে।
জহির মিয়ার প্রাত্যহিক কাজ হল , সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে ,দুটো গাভি ও দুটো বাছুর নিয়ে মাঠে ঘাস খাওয়ানো, বড় বড় ঘাসের চাপড় সন্ধান করে পেট ভড়ানো এবং হৃষ্টপুষ্ট করা । মেয়েরা বাবাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। অভাবী সংসার হলেও সেখানে আছে অনেক সুখ , আছে মানসিক প্রসান্তি । প্রতিবছর জহির মিয়া ১/২ টা বাছুর বড় করে হাটে বিক্রি করে। তাতে কিছু টাকা জমে হাতে।
গোয়াল প্রতিদিন গাভী দুয়ায় জন্য সকাল আটটা নটার মধ্যে বাড়িতে আসে। জহির মিয়া তখন মাঠে গাভীদের কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর নেশায় চোষে বেড়াই। ছোট মেয়ে নিলুফা এ মাঠে থেকে ওই মাঠ ছুটে বেড়ায়, বাবাকে খুঁজে। বাবা, বাবা গোয়াল এসেছে, তাড়াতাড়ি গাভী নিয়ে বাড়ি এসো, চিৎকার দিয়ে ডাকে। চিৎকার শুনে মাঠ কৃষকরা অনেক সময় বলে, তোর বাবা এ পাথারে আসেনি মা, অন্য পাথারে খোঁজ কর বাবাকে। ডাকের সাথে পরিচিত সবাই, ডাক শুনলেই বুঝতে পারে , জহির মিয়ার মেয়ের ডাকছে । জহির মিয়া গাভীদের প্রভাতে শিশির শিক্ত মাঠের কাঁচা ঘাস খাওয়াতে পছন্দ করেন তাতে বেশি দুধ পাওয়া যায়। গাঁও গ্রামে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে"গাই গরুর মুখে দুধ"-মুখে যত কাঁচা ঘাস দেওয়া যাবে বা খাওয়ানো যাবে, তত বেশি বেশি দুধ দেবে গাই গরু। অবশ্য সরকারি পশু ডাক্তার জহির মিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সকালে গাভীকে কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর পূর্বে খৈল ভুসি গুড়া ও লবণ মিশিয়ে পানি খাওয়াতে হবে অবশ্যই। তারপর মাঠের কাঁচা ঘাস বা শিশির সিক্ত ঘাস খাওয়ানো নিরাপদ এতে অসুখ-বিসুখ হবার সম্ভাবনা থাকেনা । তিনি ডাক্তার বাবুদের পরামর্শে মেনে গাভী দের খাওয়াতেন।
প্রতিদিন শেষ বেলা বাছুর দুটিকে ১/২ ঘন্টা আটকে রেখে, গাভী গুলি দুয়ান, তাতে এক, দেড় কেজি দুধ বের হয়। প্রতিবেশীদের বাড়ি বিক্রয় করে এক পোয়া / আধা সের নিজের পরিবারের জন্য রাখেন।
নিজের বসবাসের ঘরটি ছিল কঞ্চির বেড়ার, উপরে টিনের ছাপরা। দিনের বেলা টিনের উপর সূর্যের তাপ পড়ায়, ভেতরে প্রচুর গরম । রাতে তাড়াতাড়ি শীতল হয়ে যায়,বেড়ার ফাঁক দিয়ে, টিনের ফুটা দিয়ে চাঁদের আলো আসে।
আয় আয় চাঁদ মামা, চুমু দিয়ে যা ! চৌকির উপর পাতানো বিছানায় দুই বোনের মাঝে আদরের ছোট ভাই শুয়ে , বুবু দেখ ! চাঁদের আলো আমার মুখের উপর পড়ছে। আমি শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখছি। বড় দু বোন ছোট ভাইয়ের গালে এবং কপালে আদর করে চুমু দিয়ে বলতো, এই যে চাঁদ মামা আমাদের ছোট ভাই টির কপালে এবার চুমু দিল -এই নাও! নিচে মা মাদুর পেতে শুয়ে আছে, বাবা দরজার সামনে বারান্দায়।
মার শরীরটা ভালো নয়, চির রোগী, চলাফেরা করতে পারে ঠিকই, কিন্তু সংসারের কাজকর্ম রান্না বাড়ি করতে পারেনা । মা বললো, মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে দিনদিন ! ওদের বিয়ে-শাদী দিতে হবে, নিজের শরীরটাও ভালো নয়। কোন দিন যে মালিকের ডাক আসে, চলে যাব পরপারে। মোর অবর্তমানে মেয়েগুলো এতিম হয়ে যাবে। বেঁচে থাকতেই ওদের বিয়েশাদী দিতে চাই, দেখে যেতে চাই ওদের সুখের সংসার ।
জহির মিয়াকে লক্ষ্য করে-বলছিল ? কথাগুলি শুনছেন ? না কানের মধ্যে গেল না? ওদিক থেকে কোন সারা শব্দ এলোনা। মা রেগে বললেন, মরছে না ঘুমাইছে? ছেলেকে বলল, ডাকদে তোর বাবাকে। বিছানায় উঠে বসে খোকন বাবাকে ডাকলো:- বাবা , বাবা, -মা ডাকছে।
জহির মিয়ার এবার ঘুম ভাঙলো, হুঁশ হলো, স্ত্রী কিছুটা চেচিয়ে বলছে, বিছানায় শোয়া মাত্র সুখের ঘুম ধরে তোমাক ! দেশের রাজা বাদশারাও এত আড়ামে ঘুমায় না।
জহির মিয়া, কও , কি কবিন(বলবে)?
স্ত্রী সবিস্তারে বললো।
জহির মিয়া একটু দম ধরে, দেলুর দোজ বিয়ার ঘর আসছে। ঘটক উঠে পড়ে লাগছে। টাকা পয়সা দেয়া-থোয়া লাগবে না। বরের কোন চাহিদা নাই।
দেলুর মা,-দোজ বিয়ার ঘর! আমি কি সতীনের ঘরে মেয়েকে বিয়া দিব নাকি ?
জহির মিয়া, অসুবিধা কি? বড় ঘর ,বড় সংসার, জমা - জমি আছে ,বছর ঘরের ভাত খায় ।
দেলুর মা, কথা কেড়ে নিয়ে বলল, খ্যাক ভাত বছর ঘরের।
সতীনের ঘরে মেয়ের বিয়ে দিব না, কিছুতেই !
এটাই আমার শেষ কথা।
অদৃষ্টে লিখন ,সংসারের অভাবনটন, ঘটকের প্রলোভন, ইত্যাদি কারন জহির মিয়ার মেজ কন্যা দেলোয়ারা (দেলুর )বিবাহ দোজ বিয়া বরের সাথে সম্পন্ন হয় এক সময়। অর্থাৎ সতীরের সংসারে ঠাঁই হয় দেলুর।
বহু নারী সঙ্গমে অভ্যস্ত পুরুষদের দুই/ এক জন স্ত্রীতে আশা পূরণ হয় না বা তুষ্ট হয় না, আরো বেশি পেতে চায়, হোক তা বৈধ বা অবৈধ। আবার এ সংসারে একটি স্ত্রীকে নিয়ে অনেক পুরুষ অভাব অনটনের মধ্যে মিলেমিশে হাসিখুশিতে সোনার সংসার গড়ে-এ বাংলায়। সন্তান-সন্ততি জন্মদান করে , লালন পালন করে , বড় হলে তাদের বিয়ে-শাদী দেয়,নাতি-নাতনি মুখ দেখে , কাল কেটে যায়, একসময় সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যায়,সৃষ্টিকর্তার গড়া নিয়মে এই পৃথিবীতে।
দেলুর দোজ- বিয়া বরের লোলুপ দৃষ্টি পরে ছোট শালিকা ,সুন্দরী নিলুফার উপর। পরবর্তীতে নীলুফাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেয় স্ত্রী মাধ্যমে অথবা ভোগ করার সুযোগ চায়।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, দেলুর উপর অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন চলে বহুদিন। বিষয়টি দেলুর স্বামীর বাড়ি ও বাবার বাড়ির উভয় পরিবারে, গ্রামে নানান কানাঘষা চলতে থাকে।
পরবর্তীতে বিষয়টি কিভাবে নিষ্পত্তি হয়েছিল জানিনা।
পিতা ,জহির মিয়া তাড়াহুড়া করে ছোট মেয়ে নিলুফা কে অন্যত্র পাত্রস্থ করেন। পিতা হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।
সংসারে সারাবেলা স্ত্রী দোষ খুঁজলে অজুহাতের অভাব থাকে না। একে তো সতীনের ঘর, সকাল-সন্ধ্যা ,উঠতে- বসতে সতীনের খোঁটা, সুযোগ পেলেই ছোটলোকের বেটি, তোর বাপ যদি ভালো মানুষ হতো, মানুষের জাত হতো ,তবে তোকে সতীনের ঘরে বিয়ে দিত না ।ফকিন্নি বাপ, বেটির বিয়ে দিয়ে দায় খন্ডইছে, বাড়ি থেকে জম সরাইছে
আর আমার সোনার সংসারে আগুন লাগাইছে ! তোর বাপরে ম্যাগী, ইত্যাদি ইত্যাদি!
অন্যদিকে স্বামীর অনাদর, তাচ্ছিল্য, অবহেলা সারাক্ষণ। দেলুর জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, হাঁপিয়ে উঠেছেন সংসারে খাটতে খাটতে।আর ভালো লাগে না, এত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকাতে। স্বামীকে অনেক বুঝিয়ে -সুজিয়ে, তার হাজার শর্ত মেনে বছরে একবার মায়ের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেলে, সেথায় যেয়ে বাবাকে নিজের দুঃখের কথা বলতে পারে না, সামনে বসে শুধু কাঁদতো। বলেই বা কি লাভ?
জহির মিয়া বললো:- কি হয়েছে মা ? আমাকে খুলে বল। দেলুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে ।
বৃদ্ধ বাবাকে এ বয়সে কষ্ট দিতে চায় না দেলু।
জহির মিয়া:-মন খারাপ করিস না মা, আমি বুঝি তো দুঃখ, এবার তোর সংসার সাজাবার যা কিছু প্রয়োজন সব কিনে দিবো মা। মন খারাপ করিস না, আর কটা দিন বাবাকে সময় দে, তোর দুঃখ সইতে পারি না মা। আরো দুইটা মেয়েকে বিয়া দিছি, তারা অভাবে থাকলেও সুখে আছে। ঝগড়া বিবাদ নাই ,কলহ গন্ডগোল নাই, তোর জন্যই আমার সব দুঃখ, সবুর কর মা ,একটু সবুর কর ,আল্লাহ চোখ ফিরে তাকাবেই, তার ওপর ভরসা রাখিস। বিয়েতে তোকে কিছু দিতে পারিনি ,জামাই তোর উপর রাগ করে সেটা বুঝি না।
এক সপ্তাহ পর জহির মিয়া পরিবারের সাথে পরামর্শ না করে দু'ধাল গাভী হাটে তুলে বিক্রি করেন।
দেলুর ছোটবেলার চাওয়া- পাওয়া, তার সংসারের খুঁটিনাটি সবকিছু মিলে সংসার সাজানো জিনিসপত্র কিনলে, হাতে নগদ কিছু টাকা গুছিয়ে রাখলেন । একদিন উপঢৌকন সহ জামাই বাড়ি গেল ।
উজানী গ্রামে পৌঁছেন , জামাই বাড়ির ফটক পেরিয়ে উঠানে প্রবেশ করতেই তার সতীন মুখোমুখি হন । নানান জিনিসপত্র সঙ্গে আনার প্রথমে সতীন অবাক ! তারপর বিষ্টা মুখে মূর্তির আকার ধারণ করেন , কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সুধালে, ভালো আছেন বাবা? বাড়ির সমাচার আদি ভালো তো!
জহির মিয়া:-হ্যাঁ ভালো! তুমি ভালো আছো মা!
খচ্চাং করে উত্তর দিলেন:- এ একরকম আছি ! দিন কেটে যাচ্ছে, শুধু রক্ত ঝরছে না! বলে অন্যত্র চলে গেলো।
জহির মিয়া ব্যস্ত হয়ে দেলুকে শুধালেন, তুই ভালো আছিস মা ! জামাই কোথায় ? জামাই কে তো দেখছিনা !
বাবাকে বারান্দায় একটি পিঁড়িতে বসতে দিল, তারপর দ্রুত নিজ ঘরে প্রবেশ করে স্বামীকে বলল, বাবা এসেছে, তুমি দেখা করবে না? তোমার খোঁজ করছে বাবা, বাহিরে এসো।
দেলুর স্বামী গা টানা দিয়ে বিছনায় উঠে বসলো। দেলুকে বলল ,তুমি যাও আমি আসছি।
তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে, বের হয়ে শশুর মশাইকে সালাম দিল, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন, আব্বাজান? বাড়ির সবাই ভালো তো!
জহির মিয়া তাড়াতাড়ি পিঁড়ি থেকে উঠে এসে জামাইয়ের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে বলল তুমি ভালো আছো তো বাবা।
শ্বশুরবাড়ির যাওয়ার পথ যে একেবারে ভুলে গেছো বাবা!
দেলোকে সঙ্গে নিয়ে একবার বেড়াতে গেলে খুব খুশি হতাম, তোমার শাশুড়ি মা ও খুশি হতো।
দেলু স্বামী:-কাজ- কামে ব্যস্ত থাকি সবসময় । তাই সময় করে উঠতে পারি না। (জামাইয়ের সাথে হাত মিলিয়ে তার হাতের মধ্যে কিছু টাকা প্রবেশ করালো জহির মিয়া) তোমার শাশুড়ি কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল। তোমার হাতে তুলে দিলাম।
সংসারের অভাবের কথা জামাইকে না বলায় ভালো, তাঁতের নিচু হতে হয়।
এটা যে এক পরিবারের আয়ের উৎস, যার উপর নির্ভর করে সংসারটি চলে। গাভী বেচা টাকা তা দেলুও জানে না।
কথা বলতে বলতে জহির মিয়া দুচোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি গরিব ঠিকই! কিন্তু মিয়েটি আমার আদরের! তাকে কষ্ট দিও না বাবা, তার সাথে সৎ ব্যবহার করো , তাকে খুশি রেখো !
দেলুর স্বামী একবার বাঁকা চোখে দেলুর দিকে তাকালো, বুঝবার চেষ্টা করল, দেয়া- নেয়ার বিষয়টি, সে বুঝতে পেরেছে কিনা ?
টাকা পেয়ে জামাই মশাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বলল, আপনি এক বিন্দুর চিন্তা করবেন না! কোন অসুবিধা হবে না ! ও সুখে থাকবে !
আপনি বসুন, দাঁড়িয়ে থাকবেন না ।
আমি আসছি ! এক্ষুনি আসছি !
বাবার সাথে স্বামীর কথাবার্তা শুনে দেলুড় মনটা খুশিতে ভরে গেল । ভাবছিল বাবাকে আপ্যায়নের জন্য মিঠায়-মিষ্টান্ন ক্রয়ের উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল, শীঘ্রই রান্নার প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
দুপুর গড়িয়ে গেল তার কোন পাত্তা নাই। বাবাকে কি খাওয়াবে, দুপুরে কি রান্না করবে? সে জোগার বাড়িতে নেই।
চিন্তায় দেলুর মোনটা ছটফট করে উঠলো, সে বাহিরে বেড়িয়ে এল। এদিক- ওদিক তাকালো, মাঠের দিকে এঁকেবেঁকে মেঠো পথটি দূর প্রান্তে বড় রাস্তার সাথে মিশে গেছে , ওইখানেই হাট।
বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া দু'জন পরিচিত ওপারার মানুষকে জিজ্ঞাসা করল, তারা কি তার স্বামীকে দেখেছেন?
উত্তরে:-না দেখা হয়নি ! চোখে পড়েনি! বলে চলে গেল।
দেলুড় মনটা আরো ভেঙে পড়লো। কাঁদো কাঁদো চোখে ভাবলো বাবাকে কি খাওয়াবে, অনেকদিন পর বাবা এসেছে তার বাড়িতে।
পাতাসি নানী, দুপুর রোদে মাঠ থেকে এক বস্তা দুর্বার ঘাস কাঁকালে তুলে, দুইটা ছাগল টেনে হিঁছড়ে বাড়ি ফিরছিল। কপাল বয়ে ঘাম দর দর করে পড়ছিল। বিধবা হতদরিদ্র নারী দেলুর পরশি, বাড়ির পাশে বাঁশ ঝাড়ে ঝোপের নিচে ছোট্ট খুপড়িতে বাস করে।
পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেলুকে জিজ্ঞাসা করল, নাতবউ দাঁড়িয়ে আছ যে! দেলু কদম গাছে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফিরে তাকালো, ছল ছল চোখে জল গড়িয়ে পড়ছিল! তার প্রতি মায়া হল! মনে মনে ভাবল কদম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কান্নায় মনের দুঃখ হ্রাস করছে। কাঁকালের বস্তা মাটিতে ফেলে, কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল:-কি হয়েছে নাত বউ? মন ভার করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
দেলু:-তুমি কি তোমার নাতিকে (তার স্বামীকে) দেখেছো?
বাবা এসেছে, অনেকদিন পর, বাড়িতে মাছ ,গোস্ত কিছুই নাই শুধু আলু ছাড়া। আলু ভর্তা দিয়ে দুপুর বেলার ভাত দেয়া যায় বাবাকে? কি করবো ভেবে কুলকিনার পাচ্ছিনা। ভাবছিলাম উনি হাট থেকে কিছু কিনে আনবেন। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন পাত্তা নাই। কি যে করি! অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।
নানী:-লফের মন্ডলের ব্যাটা, তোর স্বামী, ঐ জ্যারা পাথারের মধ্যে কোন এক ঝুঁপটির মধ্যে তাসের চাটিতে (আসরে) জুয়া খেলায় মোজেছে। খোঁজ নিয়ে দেখ একবার !
তার আশা বাদ দে !
চিন্তা করিস না !
ডিম নিবি, মুরগির না হাঁসের ডিম? হাঁসের ডিম বড় বড়, বাবাকে গোটা দুটো ডিম ঝোল করে রেঁধে দে !
টোপায় হাঁস বাঁধা আছে । চাইলে একটা নিতে পারিস । কিন্তু জবাই করা, কোটা- বাছা, ও রান্না করতে বেলা গড়ে সন্ধ্যা হবে । নতুন কুটুমকে দুপুরের খাবার রাতে খাওয়াবি?
দেলু:-অতো আয়োজনের দরকার নাই, নানী। দুটো ডিম হলেই চলবে । নানী ছাগল দুটো কদম গাছের গোড়ায় খুটা গেঁড়ে বেঁধে রাখলো, কাঁকনে ঘাসের বস্তা তুলে বলল, তুই থাক আমি এক্ষুনি আসছি। দেলু বড় কদম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষণিকের মধ্যে হাঁসের চারটি বড় বড় ডিম কোছায় নিয়ে এসে দেলুর হাতে তুলে দিল ।
দেলু:-পরে ডিমের দাম তোমায় চুকিয়ে দেব নানী ।
নানী:-পারলে দিস, না দিলেও চলবে।
দেলু তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে চলল। রান্না করে বাবাকে খেতে দিল। সামনে বসে খাওয়াতে খাওয়াতে কিছু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। রান্না কেমন হয়েছে বাবা? বাবা বললো, খুব ভালো হয়েছে মা, খুব ভালো ! অকস্মাৎ প্রশ্ন করল:-তুমি কি তোমার জামাইয়ের হাতে টাকা পয়সা দিয়েছো বাবা? রান্না করার সময় মনে মনে ভাবছিল, স্বামীর হাতে কোন টাকা- কড়ি নেই। জুয়া খেলা নেশা আছে। হাতে টাকা না থাকলে, সংসারের জিনিসপত্র বিক্রয় করে অথবা বন্ধক রেখে জুয়া খেলে, যা ইতিপূর্বে অনেক বার করেছে। বলতে গেলে ঝগড়া-বিবাদ, ম্যারও খেয়েছে দেলু কয়েকবার । নানীর কথা যদি ঠিক হয় তবে সে টাকা কোথায় পেল ? করমর্দনের সময় বাবা তার হাতে মধ্যে কিছু একটা দিচ্ছিল, কিছু একটা আন্দাজ হচ্ছিল।
বাবা চুপ করে রইল, মাথা নিচু করে খাচ্ছিল।
দেলু:-বাবা চুপ করে আছো কেন,বলে?
বাবা চুপ করে রইল, কি বলবে সেটা কি তার জন্য মঙ্গল হবে, না ক্ষতির কারণ হবে মনে মনে ভাবছিল।
দেলু:-বাবা বল চুপ করে থেকো না?
বাবা:-হ্যাঁ দিয়েছি, তোর মা দিতে বলেছে।
দেলু:-আমার বাড়িতে উপঢকোনা , জামাইকে টাকা দেওয়া, তুমি এতটাকা কোথায় পেলে, বাবা ?
বাবা:-লাল গাভীটা হাটে বিক্রি করেছি মা!
দেলু:-এখন তোমরা কি করে খাবে? গাভীর দুধ বেঁচে তোমাদের সংসার চলে। এখন তোমাদের সংসার কেমন করে চলবে?
গাভী বেচার হুকুম তোমাকে কে দিয়েছে? দেলু বাবার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে, রাগে ক্ষোভে বলল, আমার জন্য তোমায় এসব কে করতে বলেছে? কেন এত উপঢৌক্ণ এনেছ । বাবার হাত দুটো নিজের গলায় এঁটে, আমায় হত্যা করো বাবা! আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের সুখ-শান্তি হবে না। আমি মরে গেলে তোমারা শান্তি পাবে। আমায় গলা টিপে মেরে ফেলো বাবা ! মেরে ফেলো! বাবা মেয়ের কান্নাকাটি চলল অনেকক্ষণ! দেলু নিজ ঘরে চলে গেল। নিজ ঘরে নিরবে অশ্রমোচন করতে করতে ভাবছিল, আমার বাবার দেয়া টাকা নিয়ে তার স্বামী জুয়ার আসরে বসেছে । শশুরের টাকা দিয়ে শশুরকে সম্মান করার জন্য সামান্য বাজার টুকু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি! কি দুর্ভাগ্য আমার! কি অপয়া আমি! কি কপাল নিয়ে জগতে এসেছি! নিজের প্রতি ক্ষোভ ঝড় ছিল মনে মনে।
বেলা গড়ে এলো, মসজিদে আসরের নামাজের আজান দিতেই, জহির মিয়া ঘর আসরের নামাজ পড়ে উঠানে এসে ডাকল, দেলু, দেলু । আয় মা, বেলা বেশি নাই। ৪/৫ ক্রোস পথ পাড়ি দিতে হবে। বাড়ি যাব মা। বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে । কাঁচা পথে গাড়ি ঘোড়া পাওয়া যায় না এখানে।
দেলু বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো, বৃদ্ধ বাবাকে অনেক বকাবকি করেছি, বিদায় বেলা অনুতপ্ত হয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না। বাবার মুখের দিকে চেয়ে বারবার অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করছিল, আঁচল দিয়ে মুছলো।
জহির মিয়া:-বিদায় বেলা জামায়ের সাথে একবার দেখা হলে ভালো লাগতো ! জামাই তো নাই!
ভালো থাক মা! আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক!
আর আমার কথা জামাইকে বলিস। তাকে নিয়ে বেড়াতে আসিস। চলি মা!
জহির মিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। দেলু বাবার পিছু পিছু বিদায় দিতে এলো। কদম গাছের ছায়ায় এসে মেয়েকে বলল তুই এখানেই থাক মা। আর যেতে হবে না আমাকে এগিয়ে দিতে। বলে মাথায় ছাতা মেলে, শরু মেঠো পথ দিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলতে লাগলো।
কদম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেলু হু হু করে কাঁদতে লাগলো, বুক ভেসে জল গড়িয়ে পড়ছিল । "নয়ন ভরে বাবাকে দেখার স্বাদ মিটিতে" -যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়-চেয়েছিল!
দেলুর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে আদি অবস্থা সাথে বর্তমান অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক। হালে অবস্থা আরো করুন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। দেলুর স্বামী রহিম মিয়া , বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা আমলেও জমি চাষাবাদ করে- বছর ঘরের ভাত খেয়ে, প্রতিবছর এক বিঘা/দশ কাঠা সম্পত্তি ক্রয় করতেন।
এখন পুত্রের আমল, রহিম মিয়া প্রতি বছর ২/১ বিঘা জমি বিক্রয় করেন । জুয়া খেলার প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। জুয়া খেলায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করার সক্ষমতা দেখে জুয়ারীরা, সাথে গ্রামের মানুষ তাকে রহিম বাদশা বলে ডাকেন। জুয়ার সাথে নারীর নেশাও কম নয়, দুটোই সমান তালে চলে।
এখন তো সংসারে অভাব আর অভাব! দিন চলাই কষ্টকর !
দেলু , এ সংসারে একবেলা খেয়ে অন্যবেলা না খেয়ে , আকঁড়ে ধরে বেঁচে আছে। তারপর সতীনের সাথে ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়া -বিবাদ সব সময় লেগেই থাকে। যার কোন শেষ নেই, যার কোন মীমাংসা নেই, এ জগত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগও নেই। স্বামীর বসতবাড়ির মাটি কামড়ে ধরে টিকে থাকা ছাড়া!
তবে এ অবস্থার স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকে না বা টিকেও না ।
অনেকদিন পার হলো। তা প্রায় ৩/৪ বছর কেটে গেল। দেলু , এ সময়ের মধ্যে একবারও বাবার দেশে আসেনি। জহির
মিয়াও মেয়েকে দেখতে তার বাড়ি যায়নি।
কয়েকদিন পূর্বের কথা । কুরবানী ঈদের (ঈদুল আযহার)পর, অসুস্থ মায়ের জোর পীড়া -পিড়িতে দেলুর বাড়ি যেতে রাজি হয়েছিল, ছোট ভাই, খোকন।
গিয়েছিল বাসে চড়ে, নেমেই মোন্নাকুড়ী ছোট হাট, হাটে ধার দিয়ে সরুপথে বিল পাড়ি দিচ্ছিল উজানী গ্রামের উদ্দেশ্যে, এখানে দেবুর বাড়ি। সঙ্গে মা'র দেয়া কুরবানীর মাংসের পাতিল হাতে ঝুলে। গ্রামে পৌঁছার পূর্বে বিলের মাঝামাঝি একজন মহিলা দূর থেকে তার দিকে দৌড়ে আসছে, হাত ইশারায় থামতে বলছে, ভাইধন থাম ! ভাইধন থাম ! ডাক শুনতে পেল ! খোকন থমকে দাঁড়ায়ে ফিরে তাকালো । মলিন চেহারা, ছিন্ন বস্ত্রে-এ অপর কেহ নয়- তার বড় বোন দেলু ! প্রখর রোদে মাঠে ছাগল চড়াচ্ছিল। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল :---কেমন আছিস ভাই ? মা বাবা কেমন আছে? বুকে জড়িয়ে কপালে দুটো চুমু দিল।
খোকন নির্বাক নয়নে চেয়ে রইল দেলু প্রতি, যেন বড় বোনকে চিনতে পারছে না। ক্ষুধা -পুষ্টিহীনতার ছাপ ফুটে উঠেছে অঙ্গে, শরীর লিকলিকে রোগা , চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে , মাথা চুলগুলো লালচে, বাবুই পাখির বাসা -একটু হাওয়াতে উড়ছে ।
দেলু হাসিখুশি মুখে বলল, কি দেখছিস-আমাকে চিনতে পারিস নি, ভাই ! আমি দেলু-তোর বড় বোন !
খোকন মাথা নেড়ে বলল, পেরেছি ,বুবু !
দেলু:- দে, পাতিল আমার হাতে দে । এর মধ্যে কি আছে রে ? মা আমার জন্য কি পাঠিয়েছে?
খোকন:-মাংস, রান্না করা ''কোরবানির মাংস” !
দেলু:-তোরা কি এ বছর কুরবানী দিয়েছিলি (হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পথে)? বাবা কি কুরবানী দিয়েছে রে?
খোকন:-না বুবু, কুরবানী দেয়নি। প্রতিবেশীরা দিয়েছে। খলিফা দাদু বাড়ি এসে দিয়ে গেছে, মসজিদে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, সেখানে অনেক মাংস পেয়েছি। (আনন্দের অনুভূতি মুখমণ্ডলে ফুটে উঠলো) হেসে বলল, সব মিলে ১০/১২ কেজি তো হবেই !
ভাই বোনের আনন্দঘন আলাপচারিতা দেখে-প্রকৃতি ও যেন মুগ্ধ হয়েছিল ! হালকা শীতল হওয়ার বইছিল চারিদিক-যেন তারই সৌজন্যে!
বোনের বাড়ি রাতটুকু থেকে পরে দিন সকালে খোকন বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিলো। গভীর রাতে দেলুর স্বামী বাড়ি ফেরাই, নতুন মেহমানের সাথে রাতে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। সকালে শালাবাবু কে সামনাসামনি দেখে বলল:-কি শালা বাবু সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে চাইছো নাকি?
খোকন:-হ্যাঁ দুলাভাই, বাড়ি যাচ্ছি।
দেলুর স্বামী:-কেন? আরো ২/১ দিন থেকে গেলে ভালো হয় না ?
খোকন:-না দুলাভাই! বাড়িতে মা বাবা অসুস্থ। একটা গাবীন গরু আছে, আর ক'দিনের মধ্যেই বিয়াবে (বাচ্চা প্রসব করবে)। তাকে-------------------।
দুলাভাই:-থাম ! হাম ! একটু থাম ভাই!
কথায় চিড়া ভিজানো যায় না রে, শালাবাবু ! বোন- ভগ্নিপতিকে বছরে অন্তত কিছু দিতে হয় ! ঈদ -লগনে, পূজা -পার্বণে দাওয়াত দিতে হয় ।
এগুলোর চলন তোদের দেশে নাই নাকি? না তোরা অন্য জাত !
অপমানজনক, কর্কশ কথা গুলো দেলুর অন্তরে বিধলো, অনতি দূরে দাঁড়িয়ে ভাইকে অপমান জনক কথা বলায় সে মনে কষ্ট পেল। তাড়াতাড়ি কথা কেড়ে নিয়ে বলল:-নাকে ক্ষত দিয়ে শ্বশুরবাড়ি না যাওয়ার পণ করলে, বউকে বছরের পর বছর আটকে রাখলে,বাবার বাড়ি না যেতে দিলে। কি করে আমার বাবা-মা জামাইকে দেবে বা ডাকবে শুনি?
দেলুর স্বামী:-তোর শোনার দরকার নাই, তোদের জাতই খারাপ!
যাও শালা বাবু যাও ! দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলে যাও!
দেলু:-যাচ্ছে, আমার ভাই এক্ষুনি যাচ্ছে !
তোমার বাড়ি যুগ যুগ থাকতে আসিনি আমার ভাই! বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
দেলুর স্বামী:-সকালবেলা, সাথ- শুভক্ষণই নষ্ট। কেন যে অজাতের সাথে সকালবেলা কথা বললাম রে ! দিনটাই মাটি ইত্যাদি, ইত্যাদি ! আক্ষেপ করতে করতে বাড়ির বাইরে চলে গেল!
খোকন ধীরে ধীরে চলে গেল। দেলু দু' চোখ মুছে ফিরে তাকালো, ভাইকে দেখতে না পেয়ে দৌড়ে বাইরে এলো, খোকনের সাথ ধরে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তোকে একটা কথা বলি ,শোন।
খোকন বললো:-বলো, বুবু।
দেলু:-মা-বাবাকে আমি কষ্টে আছি-এমন কথা কখনোই বলবি না। বলবি, আমি ভালো আছি, অনেক সুখে আছি !
খোকন বোনের অশ্রু সজল ছল ছল চোখে চেয়ে, নিজের চোখেও দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল, হ্যাঁ তাই বলবো ,বুবু!
খোকন চলে গেল!
দেলু আঁচলে চোখ মুছে বাড়ি ফিরলো।
দেলুর বাড়ি থেকে নিজ গ্রামে ফিরে খোকনের প্রায় সপ্তাহ পার হল। দেলু কেমন আছে, ভালো-মন্দ? শারীরিক অবস্থা? ইত্যাদি প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিয়েছিল খোকন। মা-বাবা খুশি হয়েছিল তার উত্তর শুনে। মা-র শরীর অনেকটা ভালো এখন।
মিথ্যা বর্ণনায় পিতা মাতা কে খুশি করলেও নিজের মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন বোধক "?"চিহ্ন রয়ে গেল । বারবার তা মুছনি দিয়ে ঘুষে মুছে ফেলতে পারেনি।
সেদিন সন্ধ্যায় মন্ডল বাড়ি কাজ শেষে খোকন বাড়ি ফিরে ঘরে শুয়ে পড়লো। উঠানে উননে নাড়ার আগুনে রান্না শেষ করেছিল মা সন্ধ্যার আগেই। বিলের আজলা (ভেদা), পুটি মাছ দিয়ে বেগুন মুলা ও পালং শাকের রসরসা চচ্চড়ি বেঁধেছিল মা। ঢাকনা তুলতেই নাকে প্রবেশ করছিল সালুনের সু-ঘ্রাণ । মা দিনে একবারই রান্না করেন, তাতে তার বাবা মা দুজনের দিনচলে চলে যায় ভালোভাবে। চেরাগ জ্বালিয়ে আলোতে ঘরের মেঝে বসে বাবাকে খেতে দিচ্ছিল মা, নিজেও নিচ্ছিল। মা বারবার খোকনকে বাবার পাশে বসার জন্য ডাকছিল। খোকন বলল: আমার পেট ভরা আছে, আমি খাব না।
মা বলল:-একটু খা বাবা। আজকের সালুনে স্বাদ হইছে , একটু খাও ! আচ্ছা ভাত না খেলেও আজলা মাছের সালুন চেকে দেখ, তোর ভালো লাগবে ! সালনের উপর পালং শাক, সর পড়ে আছে ! নে বাবা একটুখানি নেট আমি বাটিতে তুলে দিচ্ছি!
মা-র কথায় কাজ হলো না।
খোকন প্রতিদিন জোতদার পরিবার ,খলিফা মন্ডলের বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে আসে। ও বাড়িতে সে তিন বেলায় খায়। সে খলিফা বাড়ির বছরকা চাকর। এবছর খোকনের বাৎসরিক বেতন নির্ধারিত হয়েছে ৫০০/- টাকা। গত বছরের তুলনায় ১৫০/- টাকা বেশি। গত বছর ছিল ৩৫০ টাকা। মায়ের কাকতি মিনতিতে সাড়া না দিয়ে খোকন ঘুমিয়ে পড়ল। যতক্ষণ জেগেছিল" ?"চিহ্নের উত্তর খুঁজছিল মনের মধ্যে। আপনা আপনি হাতরে বেরায়। বারণ করলেও তাকে থামানো যায় না,-আপন গতিতে খুঁজে বেড়াই !
মা- বাবা মেঝে ও বারান্দা শুয়ে পড়ল।
রাত গভীর হতে চলল, দু'দন্ড আঁধার কেটে চাঁদ মামা গগনে দেরিতে উঠেছে আজ। জোছনার ছটা বেড়ার ফাঁক দিয়ে খোকনের অঙ্গ জুড়ে অর্ধেকটা বিছানা উশনায় করেছে ।
ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত খোকন ! পাশে ছোট জানালার পাল্লা খুলে কে যেন তাকে ডাকছে ? খোকন সাড়া দিল, "বুবু আসছি" ! তারপর খুশিতে-অট্টহাসি !
মা-র রান্না প্রস্তুতি, দেলু ও নীলু মাকে সাহায্য করছে। পেঁয়াজ রসুনের খোসা ছড়িয়ে, কেহ বা আদা বাটছে, মা লাউ কুটছিল । কবুতরের মাংসের সাথে লাউয়ের সালন খুবই মজাদার । খোকন বলল:- মা , মা , দেলু বুর বিয়ে কোন দিকে হবে আমি বলতে পারি ! বলবো মা ! দেলু বু বলবো ? দেলু খোকনের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল -তোকে এত মাতব্বরি করতে হবে না ! চড়টা সজোরে বসিয়ে ছিল দেলু । খোকন কাঁদতে লাগলো !
মা বলল:-ওকে মারলি কেন? অত জোরে ছোট ভাইকে কেউ মারে? কি জোরে মারলি, চটাস করে শব্দ হলো ! খোকন কাঁদছে !
দেলু:-মা ওয়ো আহলাদে কাঁদছে , জোরে মারিনি !
মা:-কষ্ট না পেলে কেউ আহলাদে কাঁদে?
মা-র কোথায় খোকন আস্কারা পেল ।
খোকন:-আমি বলবোই ওদের বিয়ে কোন দিকে হবে । চোখ মুছতে মুছতে বটির নিচ থেকে লাউয়ের বীজ সংগ্রহ করল। বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর মধ্যে রেখে চাপ দিল, ঊর্ধ্বমুখী কিছুটা উচ্চতায় উঠে পশ্চিম দিকে গড়িয়ে পড়ল। খোকনের ভেজা চোখে হাসি ফুটে উঠলো । মা দেলু বুর বিয়ে পশ্চিমে হবে । দেলু খোকনের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে দাঁত কটমট করল !
খোকন:-ওমা, দেলু বু আবার আমাকে মারতে আসছে, দেখো না আমার দিকে চেয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে ! মা বললো, ওকে খবরদার মারার চেষ্টা করবি না।
নিলুফা বলল:-নে ভাই নে ! এবার আমার বিয়ে কোন দিকে হবে বল দেখি ! নিলুফা- বু ,তোমার বিয়ে কোন দিকে হবে এক্ষুনি বলছি!
আবার আরেকটি লাউয়ের বীজ বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনী মধ্যে রেখে ঊর্ধ্বমুখী চাপ দিল, সেটিও উর্ধ্বে উঠে পশ্চিমে গড়িয়ে পড়ল। নিলুফা বুবু, তোর বিয়েও পশ্চিমে হবে, দেখিস !
নিলুফা:-না রে ভাই! তোর কথা মানতে পারলাম না! দুই বোনের বিয়ে কি একদিকে হয় রে গনক ভাই ? তোর গনা পড়া ভুয়া, সত্যি নয়, মিথ্যা ! উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ দিক গুলি কি গনক দাদার চোখে পড়েনি, না মনে ছিল না ?
একদিন দুই বোনের বিয়ে নিজ গ্রাম থেকে পশ্চিমে হয়েছিল । কাছে এবং দূরে -এই যা পার্থক্য ।
মা বলল:-এবার তোর (খোকনের) গনাপড়া শেষ, ঘর থেকে একটা ছোট গামলা নিয়ে আয়, সালন ঢেকে রাখতে হবে ।
খোকন বলল:-আমি যেতে পারব না।
দেলু বললো আমি যাচ্ছি মা, উঠে যেতেই বারান্দার সিঁড়ির উপর নিচু টিনের ছাওনি কানি, সজোরে ললাটে আঘাত করল । কেটে গিয়ে, দর দর করে রক্ত পড়তে লাগলো। পরনের শাড়ী রক্তে রঞ্জিত হল । দেলু মূর্ছা গিয়ে ,আঙ্গিনায় ধপাস শব্দে লুটিয়ে পরল। সবাই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো। মা সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীদের ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খোকন দেলুর মাথার কাটা অংশে শক্ত করে চেপে ধরল ,দুহাত বইয়ে রক্ত পড়ছিল, ও বারবার কাঁদতে কাঁদতে বলছিল আমার ভুল হয়ে গেছে বুবু ! আমায় মাফ করে দে ! মাফ করে দে বুবু!
ঘুমের মধ্যে খোকন স্বপ্নে বিছানায় ছটফট করছিল, বারবার বলছিল আমায় মাফ করে দে বুবু! আমার ভুল হয়ে গেছে ! মাফ করে দে বুবু ! আর কখনো তোর অবাধ্য হবো না !
খোকনের আর্তনাদে মা'র ঘুম ভেঙ্গে গেল । তাড়াতাড়ি উঠে বসলো, মেঝে নিজ বিছানা থেকে ডাকলো:-খোকন, খোকন ! আরো জোরে জোরে ডাকলো, খোকন, খোকন! এবার খোকনের স্বপ্ন ভেঙে গেল, জেগে উঠলো।
মা:-স্বপ্নের মধ্যে একা একা কি বলছিলি বাবা ? কাকে বলছিলে? মাফ করে দে! মাফ করে দে! মাফ করে দে বুবু! কেন বাবা?
এবার খোকন বুঝতে পারল। চুপ করে রইল। একবার বলল, কিছু না মা!
বাকি রাতটুকু তার চোখে আর ঘুম আসলো না। ক্ষণিক পর, মসজিদে ফজরের আজান দিল। বাবা উঠে ওযু করে মসজিদে গেল।
এই প্রত্যুষে,একজন আগন্তুক লোক এসে জহির মিয়ার বাড়ি খোঁজছে। জানালার ওপার থেকে এক প্রতিবেশী খোকনকে জোরে জোরে ডাকছিল, দেলুর শ্বশুর বাড়ির লোক এসেছে? দেখা করতে চায় ।
দেলুর বাড়ির কথা শুনে মা-র মাথায় যেন বাজ পড়লো ! মনে মনে হাজারো প্রশ্ন জাগলো , তাড়াতাড়ি বাইর এলো।
আগন্তুক লোককে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে বাবা? বাড়ি কোথায়? -উত্তরগ্রামের মানুষ আমি। আপনার জামাইয়ের পাশেই আমার বাড়ি।
মা:-এত সকালে কি সংবাদ নিয়ে এসেছো? কোন দুঃসংবাদ নাকি?
আগন্তুক:-আপনার জামাই আমাকে পাঠিয়েছে। আপনার মেয়ে দেলু এখন মহাদেবপুর হাসপাতালে, গতকাল ভর্তি করা হয়েছে। সে ডায়রিয়া তে আক্রান্ত হয়েছিল!
চিকিৎসা চলছে, অবস্থা ভালো না !
দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলুন!
দেলুর চাচাতো ভাই মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরল। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, আগন্তক সত্য গোপন করছে !
সামনে এসে ধমক দিয়ে বলল, সত্যি করে বল, আমার বোন বেঁচে আছে, না মরে গেছে? মিথ্যা বলবি না! তোর টুটি আমি ছিড়ে ফেলবো ! বল কি হয়েছে?
লোকটি ভয় পেল, বলল, ভালোই তো দেখে এসেছি,-এতক্ষণ কি হল জানিনা!
দেলুর চাচাতো ভাই:-লোকটির গলার টুটি চেপে ধরে বলল, সত্যি কথা বল বলছি? নইলে তোকে মেরে ফেলবো ! চারিদিকে লোকজন জমে গেল।
আগন্তুক আমায় মারিস না, ভাই,সত্য বলছি :-গত রাত ১০ মারা গেছে দেলু !
উপস্থিত মহিলারা উলুজগর দিয়ে কেঁদে উঠলো। সবাই হা- হুতাশ করছিল! কেউবা ক্ষোভে -ক্রোধে বলল, দেলুড় ডায়রিয়া হয়নি, ওকে মেরে ফেলেছে, ওর জামাই ! কেহ বলল, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে মেরেছে! অন্যজন, বিষ খাইয়ে মর্মর অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেছে! হাসপাতালে মারা গেছে দেলু!
দেলুর চাচাতো ভাই জহির মিয়ার দিকে চেয়ে বলল বড় বাবা, রহিমের বিরুদ্ধে থানায় কেস করব!
দেলু ডায়রিয়ায় মারা য়াযনি !
দেলুকে হত্যা করেছে ওর স্বামী, রহিম। ওকে ৬ শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়িব না !
আমি চললাম, খোকন আয় তুই আমার সাথে ! তোমরা আসো মহাদেবপুর ।
সবার মুখে মুখে, আহা কি কাফের ! কি পাষাণ ! মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করতে পারে, একবারও বুক কাঁপলো না !
দেলু অনেক ভালো, অনেক সাদাসিদে, কষ্ট সহ্য করে স্বামীর ঘর করছিল, এমন নিরীহ মেয়েটিকে মেরে ফেলল, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার বিচার নিজ হাতে করবে !
শোকে- দুঃখে কাতর হয়ে দাঁড়িয়েছিল জহির মিয়া । গামছায় চোখ মুছতে ছিল বারবার ।
মা মাটিতে পড়ে আছে, পাড়ার কয়েকজন মহিলা তাকে তুলে কুপের ধারে এনে
মাথায় পানি ঢাল ছিল।
এ পাড়ার ও পাড়ার মানুষের ঢল নামলো ভোরবেলায় জহির মিঞার উঠানে ভবে গেল ।
জহির মিয়া কাতর কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল:-আজ আমার মেয়ে মুক্তি পেল, আলহামদুলিল্লাহ ! আল্লাহ তাকে তুলে নিয়ে মা-র প্রতি রহমত দান করলো ! তাকে আর কষ্ট সইতে হবে না ! বেঁচে থাকতে মা আমার স্বামীর বাড়ি শান্তি পায়নি!
আমি খুশি হয়েছি, মরে যেয়ে মেয়ে আমার শান্তি পাবে। !আল্লাহ আমার মেয়ে ,দেলুকে পরপারে শান্তি দেবে নিশ্চয়ই!
মার কষ্ট আমি নিজ চোখে দেখেছি, নিজে কিছুই করতে পারেনি ! প্রতিকার চেয়েছি খোদা-তালার কাছে ! তিনি আমার আবেদন মঞ্জুর করেছেন !
ওপারে খোদাতালা তাকে শান্তিতে রাখবে নিশ্চয়ই!
মা আমার শান্তিতে থাকবে! মা আমার কবরে শান্তিতে ঘুমাক! শান্তিতে ঘুমাক !
এমন ঘটনা যদি আপনার জীবন চলার পথে সুযোগ হয় পরিচিত হবার। তবে কার্পণ্য না করার অনুরোধ রইলো ।আপনার সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দিতে, সাধ্যের শেষটুকু উজার করে দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে।
হতে পারে আপনার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সামাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবন, বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মহান দৃষ্টান্ত!
রইবে না মোর প্রয়োজনীতা
রাখবে তোরে দূরে,
নতুন আশায় বাঁধবে সে বুক
গাইবে মধুর সুরে ।।
------------------------------------------------------------------
২য় সর্গ
তখন মধ্যাহ্ন বিরতি, হাঁফ ছেড়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে লাফিয়ে পড়ল সবুজ মাঠের উপর শিক্ষার্থীর দল I গেটের বাইরে ক্ষুদে দোকানিরা চানাচুর, বাদাম, বার-ভাজা, চটপটি, আমরা মাখা, টক-ঝাল, ইত্যাদির পসরা মেলে অপেক্ষারত ।
নওগাঁ পি টি আই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের কথা বলছি । সময়কাল বিংশ শতাব্দীর আশির দশক ।মোর শহরে বন্ধু মানিক, সহপাঠীও বটে , ওকে নিয়ে গেটের বাইরে আসলাম । ভিড়ের মধ্যে ১টি আধুলি বিনিময়ে, ছোলা- বুট মাখা পৃথক পৃথক দুটো ছোট কলা পাতায় সংগ্রহ করে , ছোট কালভার্টটির ইট বিছানো মসৃণ পাড়ে পাশাপাশি বসলাম । সামনে প্রশস্ত রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় । দিনটি ছিল বুধবার , হাটবার বা হাটের্ দিন । গাড়ি -ঘোড়া ও মানুষের তাড়াহুড়ো , ছোটাছুটি , আগে যাবার প্রতিযোগিতা, দুই বন্ধুতে উপভোগ করছিল। যদিও প্রতি বুধবারের দৃশ্যপট প্রায় একই রকম থাকে ।
বড় রাস্তার ওপার, সন্নিকটে গাঁজা সোসাইটির কারুকার্য খচিত পুরাতন ভবন, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । সামনে লোহার গেট, ভিতরে প্রস্ফুটিত জবা ফুলের বাগানে, লাল টুকটুক ফুলগুলো থোকায় থোকায় শোভা বর্ধন করছে । সামনে বড় রাস্তা বরাবর গরু ও মহিষের গাড়ি গুলো সারিবদ্ধ নোঙ্গর করা। শতাধিক ধান, চাল ও খড় বোঝাইকৃত গাড়ি গুলি রাস্তার দু”পাশে এক/ দেড় কিলোমিটার স্থান জুড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গের নওগাঁ জেলা , শস্য ভান্ডার খ্যাত, বরেন্দ্র এলাকার আওতাধীন । এখানকার মাটি লাল আঁঠালো, কোথাও আবার ধূসর বর্ণের । জেলার অন্তর্গত মহাদেবপুর,পত্নীতলা, ধামুইরহাট, মান্দা,নিয়ামতপুর,পোরশা, সাপাহার ইত্যাদি ততসময় মহকুমা নামে পরিচিত ছিল । এই জেলাধীন মহকুমা গুলির বিস্তীর্ণ উর্বর জমিতে প্রচুর আমন ধান হয় । বর্ষাকালে কর্দমাক্ত এব্রো-থেব্রো, গ্রীষ্মকালে হাঁটু পরিমাণ ধুলো , বড় বড় মাঠের বুকে চিঁড়ে বয়ে চলা ছোট -ছোট খাড়ি, ছোট-বড় জাঙ্গাল কেটে গড়ে ওঠা তখনকার দিনে গাড়ি চলার সরু মেটো পথ । এই বন্ধুর পথ ধরে জনপদের মানুষ অতি কষ্টে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের আশায় শহরে আসতো । ২/৩ দিনের যাত্রায় সমাকীর্ণ দীর্ঘ ৪০/৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌস্ত শহরের কেন্দ্রে । পিচ ঢালা পথে পণ্য বোঝাই গাড়ি ,আমার ছাত্র জীবনে স্বচক্ষে দেখা, ১টি,২টি থেকে ২৮টি ধান,চাল, ও খড় বোঝাই গরু -মহিষের গাড়ির দল, লম্বা সারিতে শহরের পথে ।এমন অসংখ্য দলবদ্ধ গাড়ির চলা , গাড়োয়ানের উচ্চস্বরে যা , যা, যারে—-----, হৈই হৈই, বায়ে - বায়ে, ডানে ওঠ, ড্যানেরে– —---, চাবুকের দু-চারটি চপাং চোপাং ঘা, হাঁকিয়ে গাড়ি তাড়ানো । চাকার ক্যা—----, ক্যা—-------,হর - মর, গড়- গড়,কট- মট, খট-খট শব্দ । রাতের আঁধারে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়তো চারিদিকে, ধুরিতে ঝুলন্ত হারিকিনের মিটিমিটি আলো, দুই পাশে কাছের ও দূরের গ্রাম গুলোর ঘুমন্ত বা জাগ্রত মানুষের অনুভবে স্বস্থির আবেশ ছড়ায় । বাজারে আমদানির পরিমাণ বাড়ছে, চিন্তা নেই ! বাজারে চালের দাম অবশ্যই কমবে !
ছোলা -বুট মাখা খাওয়া শেষে , রাস্তার ওপার প্রস্ফুটিত লাল টুক টুক জবা পুহপের আকর্ষণে ও ছোট ছোট বনসুপারি সংগ্রহের আশায় দুই বন্ধু বাগানে বেড়াতে যাচ্ছিলাম । তখন দুপুর সারিবদ্ধগাড়ী গুলির চাকায় রশিবদ্ধ গরু ও মহিষগুলি খড় চিবাছিল । কেউ বা বসে বসে আরামে জাবর কাটছিল। নিচে, গাড়িগুলি দুই চাকার মাঝখানে, সংকীর্ণ জায়গায় রান্না -বান্নার কাজ চলছিল । উনুনে লোহার কড়াইয়ে গজার মাছের ব্যঞ্জনের , টগবগ করছিল। মাছের বড় বড় চাকা আর হলদে ছালুনের সুঘ্রান চারিদিক উপচে পড়ছিল,পথচারীদেরএকবারের জন্য হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল , সত্যিই তা ছিল অসাধারণ,লোভনীয়, জিভে জল আসার মত ! কাজের ফাঁকে তাদের কয়েকজন গাঁজা সোসাইটির, পার্ক ও মসজিদ সংলগ্ন পুকুরদ্বয়ের নির্মল জ্লে স্নান সেরে আহারের অপেক্ষায় বসে ছিল । পাশে, আরো ৮/১০টি গাড়ির নিচে আখাইতে একই মাছের রন্ধন কার্যক্রম চলচ্ছিল।
জানিনা কি অমৃত স্বাদ আছে গজার মাছের ব্যানজনে ? তা গ্রসন এষণা চিত্রপটে রয়ে গেল অবধি।
সামনে ক্রেতা- বিক্রেতাদের ভীর ,দরকষাকষি ,বেচাকেনা , একজন গাড়োয়ান হাত ইশারায় আমাদের ডাকলো, তাদের সাথে মধ্যাহ্ন ভোজে শরিক হওয়ার জন্য । দু” বন্ধু তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম । মানিক বললঃ ওদের ডাকে সাড়া দিয়ে একসঙ্গে খেতে দেখলে ,অন্যরা আমাদের লোভরা বা পেটুক বলবে I
তুই খাবি নাকি ? আমি প্রতিত্তরের কিছু না বলে সঙ্গে হাঁটছিলাম I
ও বললঃ বুঝেছি, তুই এক নম্বর লোভরা !
শহরের বাবুদের নানান জিজ্ঞাসা কর্ণগোচর হল । এটা কি ধানের চাল , চিকন না মোটা ?
চাল ভালো হবে তো ? এ চালের ভাত কত সময় ভালো থাকবে ? ভাত কি ফুরফুরা ,ঝরঝরা হবে , নাকি কাদাকাদা হবে ? তা স্বাদ কেমন হবে গো ? আমার গিন্নির চিকন ও ফুরফুরা ভাতে আসক্তি, মোটা চালের ভাত তার একেবারে অপছন্দ I বিক্রেতাও রসিকতা করে বললঃ দাদা আপনার জন্যই সেরা কাটারীভোগ, উপযুক্ত চাল ! নির্দ্বিধায় কিনতে পারেন ,বৌদির সঙ্গে ঝগড়া- বিবাদের সম্ভাবনা একেবারেই থাকবে না ,গ্যারান্টি দিচ্ছি ! ভাত হবে মোলায়েম, দিলখোশ !
তারপর বৌদিকে নলগাঁড়া, দীঘলি, মনসুর, অথবা গুটা বিলের গজার, টেংরা অথবা মাগুর মাছ বাজার থেকে এনে বলবেনঃ মাছগুলি ঝোল করো গো গিন্নি ! মাছের ঝোল সাথে সরু চালের ফুরফুরা ভাত মিশ্রণ মুখে মধ্যে পুড়লে, দু” চোয়ালের ডাবা দেয়ার পূর্বেই গলোধকরণ হয়ে যাবে । তার কি সুখ ! কি তৃপ্তি ! যে পেয়েছে সেই শুধু বলতে পারে । এ যেন অমৃত স্বাদ ! যুগের পর যুগ কেটে যাবে, ভুলতে পারবেন না গো দাদা ! বলতে পারবেন না !
বরেন্দ্র এলাকায় নানান জাতের ধান চাষ হয় ,জাত ভেদে এদের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে । এগুলো হলো পঙ্খিরাজ, গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাইলবালাম, রাঁধুনীপাগল, পাঙ্গাসা, কালোমেঘী, কাটারীভোগ,,তিলকাবুর, রাজাশাইল, মধুশাইল ,লেবুশাইল আরো অন্যান্য ।
খুচরা ও পাইকারি উভয় ক্রেতাদের চাহিদামত ধান, চাল ও খড় ক্রয় করছিল । সৌখিন শহরে গবাদিপশু লালন পালনকারীরা তখনকার দিনে গৃহে দুধেল দেশি-বিদেশি গাভী পালন করতো । খাঁটি দুধ, দই, ঘি, মাখন ,পাবার আশায় , সযতনে পালন করতো । গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য সামান্য মাত্রায় বিরাজমান ছিল সেসময়।
সোসাইটির বাগানের ভেতর নলকূপের পানি পান করে ছোলাবুট মাখা ঝালের ঝাঁঝানি কিছুটা কমালাম ।
মানিক বলল, লেখাপড়া করে বড় হয়ে তুই কি হতে চাস ?
গাজা সোসাইটির ফটক বরাবর সামনে একটু ভিতরে এগিয়ে দেয়ালে শ্বেত পাথরে খোদাইকৃত লেখা,
THE OFFICE BUILDING OF THE NAOGAON
GANJA CULTIVATORS” CO-OPERATIVE SOCIETY LD.
OPENED BY
THE HON'BLE NAWAB SYED NAWAB ALI CHOWDHURY
C.I.E. KHAN BAHADUR
MINISTER, GOVT. OF BENGAL
ON THE 16TH FEBRUARY 1921.
আমি বললামঃ বাংলার গভর্নর হব ।
ও বললঃ ও মা, পড়া পারিস না, আবার বাংলা গভর্নর হবি, হাঁ হাঁ হাঁ !
আমি বললামঃ গতকাল খোদাবক্স স্যারের গণিতের ক্লাসে আমি মার খাইনি I তুই মার খেয়েছিস, ভুলে গিয়েছিস বুঝি !
মানিক বললঃ তুই হবি না I আমাদের ক্লাসের ১ থেকে ৫ রোলের মধ্যে নাম আছে যাদের, ওরা হতে পারবে I
দেখছিস না, খোদা বক্স স্যারের প্রতিদিন দেয়া পাঁচটি অংকের মধ্যে একটি অংক ওদের ভুল যায় না I ওরা কত ভালো !
নে ছোট সুপারিটা খা, দেখ ভেতরের মজ্জাটা বেশ নরম, কি মজা তাই না !
আমি বললামঃ ঠিক বলেছিস, ওদের মতো আমরা পারিনা I
ও বললঃ বাদ দে ওসব কথা I
আমি বললামঃ কিছু না হতে পারলেও একজন গাড়ীয়াল তো হতে পারব I
মানিক আবার হা হা করে হেসে উঠলো I আমার কাঁধের উপর ওর হাত চেপে বললঃ মজা করলাম, মনে কষ্ট নিস না ,তোর কথায় অনেক মজা লাগলো I আমিও মন ঠিক করেছি, বড় হয়ে গ্রামের বাড়ি যেয়ে, হাল -চাষ করবো I
যে কুসুম কাননে দু জনায় আলাপচারিতার ফাঁকে ছোট ছোট বনসুপারি কুড়াচ্ছিলাম, তাঁর গৌরব গাঁথা জন্ম লগ্ন ও যৌবনে উদারতা, পরসেবার কিঞ্চিত ইতিকথা বর্ণনা দেয়া আবশ্যক । নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী অংশীদার পুনর্বাসন সমবায় সমিতি লিমিটেড , ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । এদেশের মানুষের গর্ব ,গাঁজা মহল নামে পরিচিত । প্রধান কার্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় ১লা ডিসেম্বর ১৯১৯ সালে । ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন অতিরিক্ত বাংলার এক্স সাইজ বিভাগের কমিশনার জনাব এস, সি মুখার্জি, আই , সি , এস । প্রধান কার্যালয়ের উদ্বোধন করেন তদানীন্তন অবিভক্তবাংলার মন্ত্রী জনাব নবাব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী সি, আই , ই , খান বাহাদুর । এর সভ্য সংখ্যা ৬৬০০ জন । প্রাথমিক অবস্থায় সমিতির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণে গাঁজামহল এলাকায় গাঁজা চাষ ,উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ , গুদামজাতকরণ , বাজারজাতকরণ ইত্যাদি্। সমিতি আশাতীত সাফল্য অর্জন করায় এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম সমবায় সমিতি রূপে পরিচিতি পায় । সমিতি এলাকা ১৭৭টি গ্রাম পরিবেষ্টিত ।
জনগণের সেবার লক্ষ্যে নওগাঁ শহরের ৩টি সার্কেলে , দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিল । চিকিৎসা সহ নানা জনহিত কর কাজ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি অদ্যাবধি । কিন্তু সরকারিভাবে ১৯৮৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর গাঁজা উৎপাদন ,চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যায় । সমিতির প্রচুর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আজও রয়েছে।
কালের পরিবর্তনে , রুপ ও জৌলুষের অভাব থাকলেও , নান্দনিক কারুকার্য খচিত স্থাপত্যশিল্পের ভরপুর বৈশিষ্ট্য মন্ডিত পুরাতন ইমারত গুলি দর্শনার্থীদের আজও চোখ জুড়ায় ,মন ভরায় । যা আমাদের পূর্বপুরুষদের সুকুমার প্রবৃত্তি, চিন্তাশক্তিতা ও সৃজনশীলতার পরিচয় বহন করে ।
মাথার উপর সূর্য, পশ্চিম আকাশে ঢোলতে ঢলতেই ব্যবসায়ীদের কেনা বেচা সাঙ্গ হয় I পরস্পরের খোঁজখবর নেওয়ার পালা ,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব
ছাড়তে হবে রূপের শহর
চলবে ছুটে গাড়ির বহর.
সবুজ লতার গুল্ম তলে
ঘুম ভেঙ্গে যায় পাখির বোলে,
পাথার পাড়েই গাঁ ।
দোল খেলিয়ে ডাকছে মোরে
ছোট্ট খুকি মা ।।
প্রয়োজনের ছোট-খাট জিনিসপত্র , কাপড়-চোপড় , গ্রাম্য ময়রাদের আবদার মেটাতে ,তেল- চিনি ,২-৪ টিন- বস্তা ক্রয় আরো অন্যান্য। রাতের প্রথম প্রহরে যাত্রা শুরু, শহর ছেড়ে গ্রামের পথে ,আপন ঠিকানায় একসাথে , যতদূর থাকা যায় পাশাপাশি, মিলেমিশে , সদ্য আর্থিক পরিপুষ্ট মানুষগুলির পথচলা । ঐক্য ও সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে দস্যু- দানব তাড়িয়ে গভীর অন্ধকারে অথবা জোসনা স্নাত পূর্ণিমা রাতে মহাসড়কে চলছে দলবদ্ধ গরু -মহিষের গাড়ির লহর, মনের আনন্দে ! মহা খুশিতে !
আনন্দের ঐক্যতান, বোঝায় শূন্য গাড়িগুলিতে গাড়োয়ানের যা-যা, যারে—------, বলতেই ,গরু -মহিষ গুলি তর-তর,গড়- গড় করে টানছে গাড়ি । গাড়ীয়ালের কন্ঠে ভাওয়াইয়া গানের মন মাতানো সুর ! যেন চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বইছে ! অবলা পশুগুলিও যেন নিজ নিজ ঘরে ফেরার আনন্দে আত্মহারা , ওরা হাঁটছে না ,ওরা দৌড়াচ্ছে ! মাথায় এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে , ওরা ঘরে ফেরার আনন্দে উৎবেলিত !
রাত পোহাতেই, ভোরের আলো -আঁধারের লুকোচুরিতে , মহাসড়ক ছেড়ে, গড় গড় করে নেমে পড়ল পাশের নিচু মেটো পথে, নিথুয়া পাথরের মাঝে ।
বিদায় বার্তাঃ- বিদায় ভাই-বন্ধু, বিদায় !
বেঁচে থেকো ! ভালো থেকো !
অন্নদাতা বেঁচে রাখলেঃ- আবার একদিন দেখা হবে !
দেখা হব তোমাদের সাথে ! নগর যাত্রায় !
উপর থেকে সম্মিলিত কন্ঠে আওয়াজ এলোঃ-যা ভাই যা ! ভাল থাক !পরিবার নিয়ে খুশি হলে থাকো !
বিদায় ! বন্ধু বিদায় !
(খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে ৩য় সর্গ , পঠনের আমন্ত্রণ রইল,—-----)
গ্রামের মাটির বাড়ি, প্রশস্ত উঠান । খাঁড়া দেয়ালে খড়ের ছাউনি যুক্ত উন্মুক্ত বৈঠকখানা, তার নিচে অধ্যয়নরত ছিলাম ক”জন পড়ুয়া । সূর্য তখনও ওঠেনি , ভোরের শীতল হাওয়ার স্পর্শে শরীর ও মন তরতাজা , চলছিল সরব পঠনের মাধ্যমে, শ্রেণি পাঠ আয়ত্তের অবিরাম চেষ্টা I কেবল যুক্তবর্ণ গুলি দ্রুত পঠনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল তবুও সঠিক বা বেঠিক উচ্চারণের পঠন গতি মন্দ ছিল না । গৃহ শিক্ষকের অপেক্ষায় কয়েকজন ধৈর্য হারিয়ে বাড়ি চলে গেল , রয়ে গেলাম একা । খুলির সামনের উত্তর - দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর শহরমুখী মেটো পথ । সামনে বেশ কয়েকটি তাল ও খেজুর গাছ I গাছগুলি উপর বাবুই পাখির আনাগোনা চোখে পড়ার মতো ছিল I বাতাসে ওদের বাসা গুলি তাল পাতায় দোল খাচ্ছিল I আরো নতুন নতুন বাসা বোনার,কারিগর বাবুই পাখির দল খেজুর গাছ ও তাল গাছের পাতার উপর কর্মতৎপর ছিল । খেজুর পাতাগুলি ঠোটে চিঁঁরে চিঁরে সুতলি দন্ড গুচেছ , জড়িয়ে তাল গাছের পাতা এসে বসছিল । ঠোঁট ও মাথা সমন্বয়ে নতুন নতুন কৌশল-উৎভাবনের মাধ্যমে আপন লয় বিনির্মাণে নিমগ্ন ওরা । ওদের প্রাণচঞ্চলতা , উচ্ছলতা, দলীয় কাজে একাগ্রতা , বিদ্বেষহীন মনোভাব ,সত্যিই অনুকরণীয়,উপভোগ্য I এমন আনন্দঘন পরিবেশে নিজেকে, মনে- প্রানে যুক্ত হয়ে কখন যে হারিয়ে গিয়েছিলাম, মনে নেই I
পিছনে মা দাঁড়িয়ে বললঃ লেখাপড়ায় মন না দিয়ে , রাস্তার পথচারী গণনা কর,তাহলেই পেট ভরবে ! বিদ্যালয়ে যাবার সময় পার হয়ে গেল যে , তাড়াতাড়ি নাওয়া-খাওয়া সেরে, রওনা হও।
শুরু হল আত্মদ্বন্দ্ব, একপ্রকার যুদ্ধ । অব্য সকালে শহুরের উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার ভাবনায় , অন্তরে সুপ্ত প্রশান্তি গুলো মলিন হয়ে গেল ,শ্রীহীন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল অবয়বে , কিন্তু খন্ডাবার কোন পথ নেই।
বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব পিচ ঢালা পথে ৫/৬ কিলোমিটার । গ্রামীন মেঠো পথে : পাড়া-ডারা, পুকুর- পুসকুনি , গোলান, পাথার ইত্যাদি ডিঙ্গিয়ে গেলে , ১ বা ১/২ কিলোমিটার কম হতে পারে । তাতে খুব একটা সুখ নেই, তখন শুরু হয় সূর্যের মুখোমুখি যাত্রা অর্থাৎ সকালে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয় , পূর্বমুখী শহরের বিদ্যালয়ে যাত্রা ।
আর ভালো লাগেনা,এসব পারবো না বলে বিদ্যালয় বিমুখ ছিলাম কয়েক দিন । অতঃপর হাল -চাষে নিযুক্ত ও রাখাল বানানোর পুরো বন্দোবস্ত পাকা হবার পূর্বেই আবার বিদ্যালয়মুখী হয়েছিলাম ।
তখন বর্ষাকালের একদিন, আষাঢ় কিংবা শ্রাবণ মাস ।
সংক্ষিপ্ত বা গেঁও পথে, বিদ্যালয়ে যাতায়াত সম্ভব ছিল না । পথ ছিল কর্দমাক্ত,অধিকাংশ খাল -বিল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ।
বিধায় এপাড়ার- ওপাড়ার ,পাশের গ্রামের , ৮-১০ জন পড়ুয়া পাকা রাস্তা ধরে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম । সকালের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও বৃষ্টি ঝরছিল না । বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় সচরাচর পায়ে
হেঁটে সহপাঠীদের সাথে বিদ্যালয়ে পৌঁছতাম ।
কিন্তু ফেরার পথে গ্রীষ্মের দিনগুলিতে আম্র গাছের ছায়ায় এক দণ্ড জিরিয়ে , মাঝখানের দূরত্ব দ্রুত অতিক্রম করে পরের গাছের ছায়ায় দাঁড়াতাম । পাকা সড়কে ৫০/৬০ গজ ব্যবধানে বড় বড় আম গাছ ছিল । প্রখর রোদে সড়কের পিচ গলে পাদুকা তলে লাগার ভয়ে পাশে মাটির উপর দিয়ে হাঁটতাম । দুই পাশে সারিবদ্ধ অসংখ্য আম্রগাছ ছিল অতি পুরনো ,বয়বৃদ্ধ ।
ছায়া ঘেরা , মায়া ভরা
দল বেঁধে পথ চলা ,
কি মধুর পথচলা !
শৈশবের ওই বেলা ।।
বর্ষাকালে দু পাশের গ্রাম বাসীরা গৃহপালিত, ভেড়া -ছাগলের আহার সংগ্রহ এই গাছগুলোর পাতা কেটে লোপাট করে । গাছগুলি কাণ্ড ও মোটা মোটা শাখায় অসংখ্য ছোট- বড় ,গুটি ,জট ,বা ঢিবি ছিল, অমসৃণ গাত্র দেশ, আবার কোথাও পরগাছা ও জন্মেছিল । উচ্চতা ও বেধ ভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মনে হতো দুই পাশে গাছগুলি সমবয়সী , রাস্তার জন্ম লগ্নে তার সুরক্ষার জন্য এদের রোপন করা হয়েছিল । প্রচুর পাখপাখালি , প্রজনন ঋতু বর্ষাকালে ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে গড়তো অসংখ্য নীড়,নিচে ঝুলে পড়তো এব্রোথেব্রো খড়কুঁটা ।
প্রায়শঃ , বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে, মাঝে মধ্যে চোখে পড়তো একদল ভিখারিনী মধুর আলাপচারিতায় হেঁটে চলেছে শহরের পথে । বিপরীত চিত্রও একেবারে কম নয়, নানা বিষয়ে মতানৈক্য, ভুল বুঝাবুঝি ,ন্যূনতম স্বার্থের ব্যাঘাত ইত্যাদির কারণে পরস্পরের মধ্যে বাকযুদ্ধ, তিক্ত ও কর্কশ বাক্য বিনিময় , চলার গতিকে মন্থর করে দিত দলটির । তারপর ভিক্ষা সংগ্রহে , সপ্তাহের প্রতিবারের জন্য নির্ধারিত গ্রামে মিশে যেত দলটি । দলের অধিকাংশ সদস্য মাঝারি ও বয়স্কা বিধবা, কিন্তু এদের মধ্যে একজন ছিল অতীব প্রবীণা এবং অন্ধ । সবাই মিলে তাকে সহযোগিতা করত, ধরে নিয়ে আসতো এবং নির্ধারিত স্থান চকপাথুরিয়া গ্রামের প্রবেশ মুখে, হাতকুড়ি পশ্চিমে ,পাকা রাস্তা সংলগ্ন আম্র গাছের তলায়( কিছুটা উঁচুসমতল জায়গায়) বসে রাখত এবং সামনে রাখত একটি সিলভারের থালা । সেখানে এই অন্ধ এবং অতিব বয়োবৃদ্ধা ভিখারিনীকে পথচারীরা দু পয়সার ,পাঁচ পয়সা ,দশ পয়সা কদাচিৎ সিকিও দান করত । এমনও দেখেছি ড্রাইভার বাস থামিয়ে, যাত্রীরা দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, আধুলি ছুঁড়ে দিচ্ছে । রাখাল ছেলেরা কুড়িয়ে তার থালায় এনে রাখছে ।
গাঁও বেড়ে শেষে বেলায় দলের সদস্যরা অন্ধ ভিখারিনীর পাশে এসে বসত । রোজগার ভালো হলে ,হাঁ-হাঁ, হি -হি ,চুপি চুপি পাতার বিড়ি জ্বালিয়ে ধূমপান, একে অপরের মধ্যে আদান-প্রদান , খোশগল্প, আনন্দের বন্যা বয়ে যেত ওদের মধ্যে । বিষয়টি আটপৌরে , প্রতিবেশী ,পথচারী সবারই চোখে পড়তো ।
সেদিন দ্বিপ্রহরের অনেক পর বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিলাম পথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ধরেছিল, সঙ্গে হালকা ঝড়ো হওয়ায় ,পানির কণাগুলি শরীরে বরফের দানার মত আঘাতে করছিল । ওপাড়ায় কুয়াশার মতো বৃষ্টি পড়ছে, এ পাড়ায় বৃষ্টি শূন্য । আষাঢ়ে নৌকার এক গলুই ভিজে আর অন্য গলুই শুষ্ক থাকে যেমন। আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির রোধের চেষ্টা করছিলাম । বই খাতা গুলি ভিজে নষ্ট হওয়ার ভয়ে পরিধেয় জামাটি খুলে তা মুড়িয়ে বুকের নিচে চেপে রেখেছিলাম । কেবল পশ্চিম কোলে লাল ও কালচে মেঘপুঞ্জ অপরূপ সৌন্দর্যে মজিয়েছিল ।
চকপাথুরিয়া গ্রামের কাছাকাছি পৌছালাম, চোখে পড়ল হতভাগা ভিখারিনী আম্র গাছের তলায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে, শরীর আবৃত নীল রংয়ের শাড়ি খানি ভিজে গায়ের সঙ্গে এঁটে বসেছে । পাকা রাস্তার উত্তর পাশে চকপাথুড়িয়া গ্রাম । গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু, কাঁচা রাস্তাটি গ্রামটিকে পাকা রাস্তার সঙ্গে যুক্ত করেছে । সেখান থেকে হাত ৪০ দূরে ওগায়ে প্রথম পাড়া । ওই পাড়া থেকে একজন খাটোখাটো মহিলা, উচ্চতা সাড়ে চার ফুটের ঊর্ধ্বে নয়, বয়স ৬৫/৭০ , কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল মেঠো পথ ধরে পাকা সড়কের দিকে আসছিল । তারপর দ্রুত ঘনঘন পা চালিয়ে পূর্ব দিকে অতি বয়স্ক বৃদ্ধা ভিখারিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো ।এদিক ওদিক তাকিয়ে পাশে বসলো, বৃষ্টির কারণে পথঘাট কিছুটা শূন্য ছিল। আমিও অগ্রসর ভরে ভিখারিনীর দিকে এগিয়েেএলাম।
আগন্তক বুড়িকে প্রশ্ন করলঃ- পয়সাগুলো কোনটে(কোথায়) থুচু ( রেখেছ) ?
বুড়ি কিছুটা আঁতকে উঠে বললঃ- দিমু না ।
জানিনা এ কথার অর্থ কি ? সে কি পূর্বেও এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল কিনা ? জানি না ।
আগন্তকঃ- পাড়াত (পাড়ায়) বিড়ি বাঁকি নিছু (নিয়েছ), বাঁকির টাকা পরিশোধের কথা কি ভুলে গেছু (গিয়েছ) ?
দে ,পয়সা দে !
যা আছে , সব দে !
জোর করে বুড়ির সিলভারের হালার উপর যা ছিল, আঁচলের কোনায় লুকানো গিট্টু বাঁধন খুলে ,জোর করে সব পয়সা ছিনিয়ে নিল ,নিজের আঁচল পেতে ।
বৃদ্ধ ভিখারিনী- দিমু না ! দিমু না ! আমি বাঁকি খাইনি ! বিড়ি বাঁকি কিনি নি ! বারবার চিৎকার করে বলছিল ! সারাদিনের অর্জিত রোজগার আগলে রাখা জন্য প্রাণপণ যতটুক শক্তি ছিল ধরে , চেষ্টায় করছিল নিবারণ করতে , আগলে রাখতে ! !
আগন্তুকের এক ধাক্কায় বুড়ি কাদার উপর মুখ থুবড়ে পড়ল, উঠবার শক্তি ছিল না, কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ।
আমি ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলাম ! একবার জিজ্ঞেস করলামঃ- আপনি জোর করে টাকা পয়সা কেড়ে নিচ্ছেন কেন ?
আগন্তুক মহিলা বললঃ- ওই ছোঁড়া চুপ থাক ! বাঁকি কে শোধ করবে, তুই ?
তারপর দ্রুত পা চালিয়ে পাকা রাস্তা পেরিয়ে উত্তরমুখী কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল পথ ধরে পাড়ার মধ্যে হারিয়ে গেল ।
আমি এ ঘটনাটি কারো নিকট থেকে শ্রবণ করে লিখিনি । ঈশ্বর ললাটের দেয়া দু নয়নে যাহা অবলোকন করেছি,তাহাই বর্ণনা করছি ।
হয়তো আমার বর্ণনায় , সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয় নাই বা অঙ্কিত হয় নাই । সেটা আমার অদক্ষতা, ক্ষীণ বুদ্ধি , শব্দ চয়ন ও ব্যবহারে অপটুতা ।
কিন্তু এমনটি কি কখনো, কোথাও ঘটতে পারে ?এমনটা কি বিশ্বাস করা যায় ? প্রিয় পাঠক ,সেটার ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম ।
সন্ধ্যায় ঘূনীয়ে আসছিল,মেঘের ঘনঘটা বৃদ্ধি পাচ্ছিল । আমি বাড়ির পথে রওনা হলাম।
জানিনা অভাগিনীর কি হয়েছিল ? কেমন করে বাড়ি গেল ?
তবে বারবার তাঁর কথা মনে পড়ছিল ।
(খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে ৪র্থ সর্গ, “ মোহন্ত ধাওয়া ”(জেলে) পঠনের আমন্ত্রণ রইল,—-----)


Post a Comment
0Comments