গোধূলি
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
নিচে স্বচ্ছ জল,মাঝে মাঝে বাঁশের খুটি পোতা । উদাস দুপুর গড়িয়েছে, দুই- একজন কৃষাণ -কৃষাণী মাঠে ফিরতে শুরু করছে । শান্ত বিকেলের কমল স্পর্শে খোলা প্রান্তে ছোটদিঘির পাড়ে উপর নরম ঘাসের বসে শুনছিলাম ওদের মিষ্টি কূজন। দিননাথ অস্ত যেতে তখনও হাত দেড়েক বাঁকি । বনকুলের নুয়ে পড়া ডাল থেকে কাঁচা- পাকা কয়েকটি কুল ছিঁড়ে কোছায় রেখেছিলাম । দু /একটি মুখে পুড়লাম ,কি স্বাদ ! এই অমৃত স্বাদ গ্রহণের লোভে প্রতিবছর অন্তত একবার এখানে আসি । নিচে ঘাট, বিলা-দিঘিতে নাওয়া সাড়ার জন্য কোন জনমানুষ এখানে আসে না। কেবল মাঠে উৎপাদিত শাক-সবজি বাজারজাতকরণের পূর্বে কৃষকরা ধৌত করে তরতাজা রাখার জন্য। পিছনে হাত পঞ্চাশ দূরে দ্বিতল ঘর ভিটার কোণে । নিচতলা ফাঁকা, শিয়াল -কুকুর ,মানুষজন অবাধে চলাফেরা করতে পারে। উপর তলার ঘরটি বাঁশের চাটাই দিয়ে মোড়ানো ,মই লাগিয়ে প্রবেশ করতে হয়। মই টেনে মাচানের উপরে রাখলে , কারো পক্ষে দ্বিতল ভবনে উঠা সম্ভব নয় ।
তবে প্রশ্ন জাগে মনের কোণে, গভীর রাতে ,ঘোর অন্ধকারে. জনমানব শূন্য খোলা প্রান্তরে, এই ছোট্ট ঘরটিতে এক থাকা কি সত্যিই সম্ভব ?
এটা বিলের মধ্যভাগ, চারিদিকে দূরের গ্রামগুলি এক /আধ কিলোমিটার ব্যবধানে অবস্থিত। ছাগল- চরানী, ঘুটা-কুড়ানি,অস্বচ্ছল প্রৌঢ়া পতিহীনা রমণীরা যারা পল্লী গ্রামে গবাদি পশু লালন-পালনে জীবিকা নির্বাহ করেন , তাদের একজন মাঠে ঘাস খাইয়ে ছাগলগুলির পেট পরিপুষ্ট করে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল । অন্যজন গৃহস্থের ফসলের বেড়ার কিয়দংশ (কঞ্চি -গোঁজা) টেনে -হিঁচড়ে এদিক- ওদিক নজর রেখে নিচু জোলা দিয়ে যাচ্ছিল ,তার মাথা একবার দেখা যাচ্ছিল পরক্ষণে হারিয়ে যাচ্ছিল।
দিনভর ,খাদ্য অন্বেষণে মশগুল,হাজারো পাখি ঘুঘু, সারস , শালিক, ফিঙ্গে,মাছরাঙ্গা,দোয়েল ইত্যাদি । বেলা শেষে তৃপ্ত মনে দিঘির উপর পল্লী বিদ্যুতের টানা তারের উপরে বসল। অভিজ্ঞতা বিনিময় তথা সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার খেয়ালে, খোশগল্প ও আলাপচারিতায় মজিয়েছে ওরা । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আর বেশি দেরি নেই ,আবির রং ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম গোলার্ধ । দিবা রাত্রির সন্ধিক্ষণে, গোধূলি লগ্নে একে একে ওরা উঠতে শুরু করলো, পাশে গ্রামের নিকটবর্তী বাঁশবাগানে ছোট্ট নীড়ে ,আপন ঠিকানায়।
একটি কর্মব্যস্ত দিনের অবসান ঘটলো, পরম করুণাময়ের গড়া নিয়মে , প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে পড়ল প্রাণীকুল । অপেক্ষায় -আর একটি নতুন প্রভাতের প্রত্যাশায় !
আমিও রওনা হলাম, বড় রাস্তায় দিকে । কয়েকজন রাখাল বালক শুকনো কচুরিপানা গাদায় আগুন লাগিয়ে, ধুয়োর কুন্ডলী তালগাছ সম উচ্চতায় ছড়িয়েছিল । শিয়ালের হুক্কি -হুওয়া ডাক শোনা যাচ্ছিল ,ওরা কোলাহল ও আনন্দে নাচানাচি করছিল।
আধার ঘনীভূত হচ্ছিল । বড় রাস্তার উঠলাম তারপর গায়ের হাঁটতে শুরু করলাম ।

Post a Comment
0Comments